রাজ্য সরকারের উদ্যোগ, এবার জেলবন্দির আঁকা ছবি বিক্রি হবে অনলাইনে
চার দেওয়ালের মধ্যে বসেই তাঁরা ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলেন মনের ভাষা। রং আর তুলির আঁচড়ে সৃষ্টি হয় একের পর এক ছবি। কখনও মনীষীদের ছবি, কখনও বা প্রাকৃতিক দৃশ্য, কিংবা প্রতিদিনের রোজনামচার খণ্ডচিত্র তাঁদের হাত দিয়েই ফুটে ওঠে ক্যানভাসে। এতদিন এই সব ছবি স্থান পেত হয় সংশোধনাগারের দেরাজে, কিংবা আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের আর্ট গ্যালারিতে। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন প্রদর্শনীতেও জায়গা পেত তাঁদের এই সৃষ্টি। এবার আর শুধু প্রদর্শনীতেই সীমাবদ্ধ থাকছে না বন্দিদের আঁকা ছবি। বিক্রি হবে অনলাইনে। কারা দপ্তরের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিভিন্ন জেলের বন্দি শিল্পীরা। তাঁদের কথায়, রাজ্য সরকার যেভাবে আমাদের এই সৃষ্টিকে তুলে ধরার প্রয়াস নিয়েছে, তা নজিরবিহীন। এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন এই বন্দিদের যিনি হাতেকলমে কাজ শিখিয়েছেন, সেই শিক্ষক চিত্ত দে’ও।
২০১১ সালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর জেলের সামগ্রিক ছবিটাই বদলে গিয়েছে। প্রতিটি কেন্দ্রীয় ও উপ-সংশোধনাগারে একের পর এক নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করায় জেলকর্মীদের পাশাপাশি বন্দিদের মধ্যেও বেড়েছে সৃষ্টিশীল কাজের প্রতি উৎসাহ। কারা দপ্তর চেয়েছিল, বিভিন্ন বন্দির মধ্যে সুপ্ত থাকা সাংস্কৃতিক চেতনাকে উস্কে দিতে। আর এই কাজে তারা একশো শতাংশ সফল।
কারা দপ্তর সূত্রের খবর, দমদম, প্রেসিডেন্সি, বনগাঁ, বসিরহাট, বর্ধমান লালগোলা, মেদিনীপুর, হাওড়া, কৃষ্ণনগর প্রভৃতি জেলের বেশ কয়েকজন বিচারাধীন ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দি নিয়মিত ছবি আঁকেন। সেই ছবি নানা সময় প্রশংসিত হয়েছে। এমনকী জেল পরিদর্শনে এসে বিভিন্ন বিশিষ্ট মানুষ সেই ছবি কিনেও নিয়ে গিয়েছেন। কোনও কোনও প্রদর্শনীতে অল্পস্বল্প ছবি যে বিক্রি হয়নি, তা নয়। সেই ছবির বিক্রি টাকা তুলে দেওয়া হয়েছে ওই জেলবন্দি শিল্পীদের হাতে। তবে এতদিন তাঁদের আঁকা ছবি বাজারজাত করার তেমন পরিকল্পনা কারা দপ্তরের ছিল না। সম্প্রতি এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে রাজ্যের বিভিন্ন জেলে যে বন্দিরা ছবি আঁকেন, তাঁরা বাড়তি উদ্যমে শান দিতে শুরু করেছেন শিল্পীসত্ত্বায়। আলিপুর ও দমদম সেন্ট্রাল জেলের মহিলা বন্দিরাও রং-তুলি নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সৃষ্টির উল্লাসে। জানা গিয়েছে, বনগাঁ, বসিরহাট, বারুইপুর জেলের বন্দিরা ইতিমধ্যে জলরং দিয়ে এঁকে ফেলেছেন উৎসবের ছবি। সেই ছবিতে রয়েছে সম্প্রীতি ছাপ।
এক জেল কর্তার কথায়, কোন বন্দি অপরাধী হয়ে জন্মায় না। কিছু ঘটনা, সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির কারণে কোনও মানুষ অপরাধের শিকার হন। কয়েক বছর আগে বন্দিদের নিয়ে একটি অঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে অংশ নিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন বউবাজার বিস্ফোরণকাণ্ডের অন্যতম পান্ডা রশিদ খান ও অন্ধ্রের মাওবাদী নেতা তেলুগু দীপক। একজন দোষী সাব্যস্ত, আরেকজন বিচারাধীন। এই দু’জনের ছবি তারিফ কুড়িয়েছে সবার। প্রশংসিত হয়েছিলেন দু’জনেই।
বন্দিদের অঙ্কন শিক্ষক চিত্ত দে বলেন, ২০০৭ সালে সংশোধনাগারে ছবির পাঠশালা শুরু। আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে আর্ট স্কুল গড়ে তোলার মধ্যে দিয়েই বন্দিদের মধ্যে ছবি আঁকার বীজ বপন করেছিলাম। ধীরে ধীরে রাজ্যের সব কেন্দ্রীয় ও উপ সংশোধনাগারগুলিতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। ২০১২ সালে আলিপুরেই গড়ে ওঠে আর্ট গ্যালারি। নাম সৃষ্টিকলা ভবন। বন্দি শিল্পীরা ছবির মধ্যে দিয়েই নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করেন। তাঁদের মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। নিজেকে শোধরাতেও সাহায্য করে এই শিক্ষা। এর ফলে চার দেওয়ালের জীবন শেষে মূল স্রোতে ফিরতেও সাহায্য করবে তাঁদের।