চুলের যত্নে আয়ুর্বেদ
পুজো প্রায় দোরগোড়ায়। ক’দিনের মধ্যেই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে ‘ফিটফাট’ হতে হবে। রূপচর্চায় রাখা চলবে না একবিন্দু খামতি। তাই হাতেগোনা কয়েকদিনে চুলের যত্ন নিতে হবে। আর সত্যি বলতে করোনায় বাড়িতে বসেই বাহারি চুলের সৌন্দর্য বজায় রাখা সম্ভব।
গোড়ার কথা
চুল সুস্থ রাখার নানা পদ্ধতি নিয়ে আলোচনার আগে চুলের গঠন নিয়ে দু-চার কথা জেনে নেওয়া দরকার। মাথার ত্বকের (স্ক্যাল্প) অন্দরে থাকা চুলের অংশকে বলে হেয়ার ফলিকল। আর মাথার উপরে থাকা অংশ, অর্থাৎ যেই অংশকে আমরা চুল বলে চিনি, তাকে বলে হেয়ার শ্যাফ্ট। হেয়ার ফলিকলের নীচে থাকে বেশকিছু রক্তনালী। এই রক্তনালীগুলি চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।
ভেষজ শ্যাম্পু
নিয়মিত চুল এবং মাথার ত্বক পরিষ্কার রাখা দরকার। নইলে খুশকি থেকে শুরু করে নানা ধরনের সমস্যা চেপে বসতে পারে। এক্ষেত্রে চুল পরিষ্কার রাখতে শ্যাম্পুর জুড়ি নেই। তবে বাজার চলতি অনেক শ্যাম্পুর মধ্যে উপস্থিত রাসায়নিক চুলের ক্ষতি করতেও পারে। এই সমস্যা সমাধানে বাড়িতেই বানিয়ে নিতে পারেন ভেষজ শ্যাম্পু।
এক্ষেত্রে রাতের বেলায় আমলকী চূর্ণ এক থেকে অর্ধেক চামচ অর্ধেক থেকে এক কাপ জলে ভিজিয়ে নিন। এক থেকে দু’টি শিকাকাই ফল ভেঙে এক থেকে অর্ধেক কাপ জলে ভিজিয়ে নিতে হবে। আর চুল বুঝে এক থেকে দু’টি রিঠার বীজ ফেলে খোসাটাকে এক থেকে অর্ধেক কাপ জলে ভিজিয়ে রাখতে হবে।
এরপর সকালে উঠে ওই তিনটে কাপের জল ছেঁকে নিয়ে মেশাতে হবে একসঙ্গে। তারপর সেই জল মাথায় মেখে শ্যাম্পু করা যায়। খুশকি, চুলের ডগা ভেঙে যাওয়া, জেল্লা ফেরানো সহ চুলের সার্বিক যত্নে এই শ্যাম্পু খুব ভালো কাজ করে।
রুক্ষভাব কাটাতে
রুক্ষ-শুষ্ক চুল মেরামতিতে শ্যাম্পুর পর কন্ডিশনিং করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে এক মগ জলে একছিপি ভিনিগার ভালো করে মিশিয়ে নিয়ে শ্যাম্পুর পর মাথায় ঢেলে নিন। দেখবেন চুল ভালো থাকবে।
খুশকি সমাধানে
চুলের ত্বকে ছত্রাক সংক্রমণের কারণে খুশকি হয়। সাধারণত তৈলাক্ত ত্বক, বেশি ঘামেন— এমন মানুষের খুশকির সমস্যা বেশি দেখা যায়। খুশকি সমাধানে প্রাথমিকভাবে দুই দিন অন্তর ভেষজ শ্যাম্পু ব্যবহার করা যেতে পারে।
এছাড়া স্নান করার আগে পাতিলেবুর রস চুলে হালকা করে ম্যাসাজ করে নিতে পারেন। তারপর ভেষজ শ্যাম্পু ব্যবহার করে চুল ধুয়ে নিন। আবার ঝাঁঝি পেঁয়াজ নামের ছোট ছোট দেশি পেঁয়াজের রস স্নানের এক ঘণ্টা আগে স্ক্যাল্পে লাগিয়ে শ্যাম্পু করে নিলে খুশকির সমস্যা কমে।
এছাড়া সন্ধের দিকে টঙ্কন ভস্ম এক চামচের চার ভাগের এক ভাগ নিয়ে নারকেল তেলের সঙ্গে মিশিয়ে মাথার ত্বকে আলতো করে ম্যাসাজ করে নিতে হবে। তার পরদিন সকালে শ্যাম্পু করে নিলে খুশকি কমবে। অন্যদিকে কাঁচা আমের আঁটির মজ্জা অর্ধেক চামচ এবং হরীতকী চূর্ণ অর্ধেক চামচ একসঙ্গে বেটে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে নিয়ে মাথায় লাগাতে হবে। লাগানোর এক ঘণ্টা পর শ্যাম্পু করে মাথা ধুয়ে নিতে হবে।
দীর্ঘদিনের খুশকিতে যষ্ঠীমধু পাউডার, আমলকী পাউডার ও তিল অর্ধেক চামচ নিয়ে একসঙ্গে বেঁটে মাথায় লাগান। এক ঘণ্টা পর শ্যাম্পু করে নিন।
অকালপক্কতা ঠেকাতে
বয়স বাড়লে চুল পাকবেই। কিন্তু অনেকের কম বয়সেই চুল পেকে যায়। নেপথ্যে রয়েছে শরীরের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চন্দনার্দ তৈল দুই ফোঁটা করে দুই নাকে দিনে দুইবার দিতে হয়।
এছাড়া চুলের নিজস্ব রং বজায় রাখার জন্য লোহার পাত্রে অর্ধেক বা একটি আমলকী এবং দুই-তিনটি জবা ফুল একসঙ্গে বাটতে হবে। তারপর ঘণ্টাখানেক সেই বাটা পাত্রের মধ্যেই রেখে দিন। এরপর সেই বাটা স্ক্যাল্পে মাখতে হয়। এক ঘণ্টা পর শ্যাম্পু করে ধুয়ে নিলে ভালো ফল মেলে।
চুল পড়া কমাতে
কেসুদ পাতার রস বেটে মাথায় লাগিয়ে এক ঘণ্টা রেখে দিন। তারপর শ্যাম্পু করুন। এর মাধ্যমে চুল পড়া কমে। নতুন চুল গজায়। চুল ঘন হয়।
এছাড়া আমলকী এবং কচি আমের আঁটি বেটে নিয়ে চুলে লাগাতে পারেন। তারপর এক ঘণ্টা পর শ্যাম্পু করে নিন। আবার ঝাঁঝি পেঁয়াজের রস স্নানের এক ঘণ্টা আগে স্ক্যাল্পে লাগিয়ে শ্যাম্পু করে নিলে চুল পড়ার হার কমে। এছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শ মতো মহাভৃঙ্গরাজ তেল, যষ্ঠীমদ্বাদ্য তেল নাকে ড্রপ নিলে এবং মাথায় ম্যাসাজ করলে ভালো ফল মেলে।
চুল রং করতে
পুজোয় চুলে রং করার শখ থাকে অনেকের। ভেষজ পদ্ধতিতেও চুল রং করা সম্ভব। অর্ধেক কাপ কড়া করে চায়ের লিকার বানান। এই লিকারের মধ্যে এক মুঠো মেহেন্দি পাতা বেটে রাতের বেলায় মিশিয়ে দিন। পরদিন সকালে এই পেস্টের সঙ্গে লেবুর রস মিশিয়ে চুলে লাগান। এক ঘণ্টা পর শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে নিন। এর মাধ্যমে চুলে বাদামি রং পাওয়া যায়।
খাবারে মনোযোগ
চুলের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে চাইলে শুধু বাইরে থেকে চুলের যত্ন নিলেই চলবে না। দরকার অন্দর থেকে খেয়াল রাখারও। স্বাস্থ্যকর খাদ্যই পারে চুলের সমস্ত দিকের খেয়াল রাখতে।
চুল গঠনের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হল কেরাটিন নামের প্রোটিন। ডিম, পেঁয়াজ, মিষ্টি আলু, আম, সূর্যমুখী ফুলের বীজ ইত্যাদি খাদ্যে ভালো পরিমাণে কেরাটিন থাকে।
চুলের পুষ্টির জন্য বায়োটিন নামক উপাদানের খুব দরকার। বায়োটিন ডিমের কুসুম, মিষ্টি আলু, চীনেবাদাম, ব্রকোলি, মাশরুম, মাংসের লিভার ইত্যাদিতে।
ভিটামিন এ চুলের পাশাপাশি ত্বকের স্বাস্থ্যও বজায় রাখে। দুধ, ডিম, মাছ, মাংস, টম্যাটো, গাজর, পাকা পেঁপে, পাকা আম, কর্ড লিভার অয়েল ইত্যাদির মধ্যে ভিটামিন এ পাওয়া যায়।
চুল ভালো রাখতে আয়রনের অত্যন্ত প্রয়োজন রয়েছে। শরীরে আয়রনের ঘাটতি থেকে অ্যানিমিয়া হলে চুলের কোষের পুষ্টি বিঘ্নিত হয়। মাছ, মাংস, ডিম, মাংসের লিভার, লাল শাক, নটে শাক প্রভৃতি খাদ্যে রয়েছে আয়রন।
ভিটামিন সি শরীরে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট রূপে কাজ করে। এই ভিটামিন শরীরের ক্ষতিকারক টক্সিনগুলিকে নিষ্ক্রিয় করার কাজ করে। চুলের স্বাস্থ্যরক্ষার্থেও এই ভিটামিনের অত্যন্ত গুরুত্ব রয়েছে। বিভিন্ন ধরনের লেবু, আমলকী, পেয়ারা, সবুজ শাক ইত্যাদিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি থাকে।
চুলের সুস্বাস্থ্যের জন্য ভিটামিন ডি এবং ক্যালশিয়ামও প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কড লিভার অয়েল, মাখন, ডিমের কুসুম, সূর্যালোকে ভালো পরিমাণে ভিটামিন ডি মেলে। অন্যদিকে দুধ, দই, পনির, মাছ, মাংস ইত্যাদি খাদ্যে থাকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্যালশিয়াম।