সরঞ্জাম অগ্নিমূল্য, প্রতিমা গড়তে ঋণের ফাঁসে কুমোরটুলি
করুণা করেননি সিদ্ধিদাতা গণেশ। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন শীতলা, অন্নপূর্ণা। কার্পণ্য দেখিয়ে মর্ত্য ছেড়েছেন বজরংবলী, বিশ্বকর্মাও! মার্চ থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। বারো মাসের মধ্যে সাতমাস। বাঙালির তেরো পার্বণের আঁচ পড়েনি কুমোরটুলি পাড়ায়। গণেশ, শীতলা, অন্নপূর্ণা, বজরংবলী, মায় বিশ্বকর্মাও গড়তে পারেননি শিল্পীরা। তা বলে তো আর দেবী দুর্গাকে বাদ দেওয়া যায় না! দেনায় ডুবে হলেও প্রতিমা গড়ছেন তাঁরা। আর গড়তে গিয়ে বুঝতে পারছেন—‘মুনাফার অঙ্ক ঘরে তোলা দূরে থাক। ঋণের ফাঁসে জড়িয়ে যেন ঘটিবাটি বেচতে না হয়!’
মার্চ মাস থেকে কিছু না কিছু দেবদেবীর প্রতিমা তৈরির বরাত পায় কুমোরটুলি। সেই আয়ের একটা বড় অংশই ব্যয় হতো উমার সংসার গুছিয়ে তুলতে। একেবারে নিখুঁত বাজেট। সামান্য হেরফের হওয়ার জো নেই। অঙ্ক কষেই প্রতিমার কাঠামো নির্মাণ। ফি বছর এটাই দস্তুর কুমোরটুলির। এবং এটাই সহজ হিসেব। এবার মার্চ থেকে প্রায় আড়াই মাসের লকডাউন।
কোভিড সংক্রমণের ভয়ে দেবদেবীর আরাধনাতেও মন ছিল না বাঙালির। ফলে কুমোরটুলির সব হিসেবেই ওলটপালট। ধরা বাজেটে প্রতিমা গড়া যাচ্ছে না। বাঁশ কিনতে দড়ি ফুরোচ্ছে। খড় আনতে গিয়ে টাকা জুটছে না পেরেক কেনার! সরঞ্জামের বাজার অগ্নিশর্মা। বাজেট বেড়েছে দ্বিগুণ। অতিরিক্ত ব্যয় সামলাতে শিল্পীদের কাউকে হাত পাততে হয়েছে আত্মীয়দের কাছে। চড়া সুদে ধার নিতে কেউ হত্যে দিয়েছেন মহাজনের ঘরে। কেউ আবার ব্যাঙ্কে। কেউ কেউ পরিবারের আপৎকালীন সঞ্চয়ও ভেঙেছেন।
একচালার প্রতিমা গড়তে অন্যান্য বছর যেখানে ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ পড়ত। ধারদেনা করে সেটা গড়তে এবার খরচ পড়ছে ৩০-৩৫ হাজার টাকা। ডাকের সাজের বাড়তি কারুকাজ হলেই ৪০ হাজার। এত বেশি? ভুরু কুঁচকে জানতে চাইছেন উদ্যোক্তারা। মহামারীর দুঃসময়ে বাজার মন্দা। কেনাকাটা নেই। স্পনসর নেই। বাড়তি চাঁদা আদায়ের সম্ভাবনা নেই। প্রতিমার দাম কি একটু কমানো যায় না?
কুমোরটুলির ঋণগ্রস্ত শিল্পীদের সাফ জবাব—‘সবই বুঝতে পারছি। কিন্তু, আমরা নিরুপায়। দয়া করে এবারে এই অনুরোধটুকু করবেন না। গত বছর পাঁচ বান্ডিল খড় কিনেছিলাম ১৫০ টাকায়। এবার সেটাই ৩০০ টাকা। পাটের দাম কেজি প্রতি ৫০ থেকে বেড়ে হয়েছে ৯০ টাকা। এক কেজি দড়ির দাম ছিল ৮০ টাকা। এখন ১২০ টাকা। সব জিনিসের দামই আকাশছোঁয়া।’ কুমোরটুলি স্ট্রিট, রবীন্দ্র সরণী, বনমালি সরকার স্ট্রিট-সহ গোটা পটুয়াপড়ায় এভাবেই চলছে দর কষাকষি। মন কষাকষি। বরাত দিয়েও প্রতিমার দাম কমানোর অনুরোধ করছেন উদ্যোক্তারা।
পরিস্থিতি সত্যিই বেশ কঠিন। ধার সর্বত্র। রঙের দোকানে, বাঁশের দোকানে, পেরেকের দোকানে, খড় ব্যবসায়ীদের কাছে। সবাই মুখিয়ে রয়েছেন—কবে শিল্পীর ঘরের উঠোনে লরি কিংবা ম্যাটাডোর আসবে!