বিজয়িনীর হাসি আর আয়ত চোখের স্নিগ্ধতায় মা
অবিভক্ত বাংলার এক শরৎ। আকাশে মেঘের আনাগোনা। ঘাস ভিজে গিয়েছে শিশিরে। সূর্যের আলোয় তার এক একটা বিন্দু থেকে অজস্র রং ঠিকরে পড়ছে যেন। বাড়ির পাশে নদীর ধারে চুপ করে বসে আছে ছেলেটা। কতই বা বয়স,বছর পনেরো- কুড়ি বড়জোর। গ্রামের নদী, পুকুর, খাল বিলের জল আর সেই জলে বসবাস করা মাছের ধরণ ঘুরে ঘুরে দেখা আজকাল নেশার মত পেয়ে বসেছে তাকে। মাঝে মাঝে মাছগুলো কেমন চলে আসে পুকুরের ধারে, ঘাই মারে ঘাটে! সারাদিন বসে বসে সে সবই দেখে ছেলেটা। কিন্তু এমন নদীনালার দেশে একটা পুকুর, একটু জমিও যে নেই তাদের নিজেদের। গ্রামের পুকুরে মাছ ধরা বড় অশান্তির। অন্য কোনও কাজও জুটছে না। নিজে খাবে কী, আর অসুস্থ মাকেই বা খাওয়াবে কী? এই অজ পাড়াগাঁয়ে বসে থেকে যে কিছু হবে না, বেশ বুঝে গিয়েছে সে। কাজের সন্ধানে পাড়ি দিতেই হবে বড় কোনও শহরে। কলকাতার নাম শুনেছে ছেলেটা। সে শহর নাকি কাউকে খালি হাতে ফেরায় না। সেই শরতেই দেবী যখন গ্রামে আসছেন,কপর্দকহীন অবস্থায় মাকে নিয়ে এক চিলতে বাড়িটা ছাড়ল সে।
যশোহর থেকে কলকাতায় এসে বেলেঘাটায় এক এঁদো গলির ঘুপচি ঘরে ওঠা। দারুণ করিতকর্মা এমনিতেই, কাজের সুযোগও আসতে লাগল নানারকম। কিন্তু ছেলেটার মন পড়ে থাকে জলে। কী সুন্দর নদী বয়ে গিয়েছে বাড়ির কাছ দিয়ে। বিদ্যাধরী নাম তার। জনহীন ধু ধু প্রান্তর। সেখানে মাইলের পর মাইল শুধু জল আর জল। জলের গভীরতা কম, গুন দিয়ে নৌকা টেনে নিয়ে যায় মাঝি। জায়গাটা বড় মনে ধরল ছেলেটার। চমৎকার মাছ ওঠে নোনা জলে। এইখানেই মাছের চাষ শুরু করল সে। আস্তে আস্তে বাড়তে লাগল ব্যবসা। পাঁশুটে, রুপোলি মাছ সৌভাগ্যের ঝুলি উপুড় করে দিল ছেলেটার হাতে। বয়স বাড়তে লাগল। পাল্লা দিয়ে বাড়তে লাগল ব্যবসা বুদ্ধি। এক ডাকে লোকে তখন চেনে গগনচন্দ্র সরকারকে।
যে গলির মধ্যে ছোট্ট একটা ঘরে একদিন কোনও রকমে মাথা গুঁজেছিলেন ছেলেবেলায়, তারই পাশে এবার বিরাট বাড়ি বানালেন গগনচন্দ্র। বৈঠকখানা, ঠাকুরঘর, নাটমন্দির তৈরি হল আস্তে আস্তে। নিতান্ত বালক বয়সে কোনও এক শরতে দেবীর আগমনের ঠিক আগেই শূন্যহাতে গ্রাম ছেড়েছিলেন। সে কথা ভোলেননি কোনও দিনই। এবার সেই দেবীকেই সাদরে বরণ করে নিজ গৃহে নিয়ে এলেন গগনচন্দ্র। ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দে বেলেঘাটার সরকারবাড়িতে শুরু হল পুজো। সেই বাড়িতে এখন তিনটি পালায় পুজো হয়। এই বাড়ির পুজোর একটি বড় বৈশিষ্ট্য হল- একটি তরফের পুজো এক সময়ে ছিল সম্পূর্ণরূপে মহিলা পরিচালিত। গগনচন্দ্রের উত্তরপুরুষ গণপতি সরকারের আট কন্যার অন্যতম হাসিরানি দেবী এই পুজো করতেন। তাঁকে সাহায্য করতেন বাকি বোনেরা। এ প্রাপ্তি নেহাত কম ছিল না।
সরকার বাড়িতে প্রতি বছর জন্মাষ্টমীর দিনে প্রতিমা গড়ার কাজ শুরু হয়। সাবেক একচালার প্রতিমা। দীপ্ত আয়তাকার চোখ আর মুখে বিজয়িনীর হাসি নিয়ে এবাড়ির দেবী অনন্যা।ষষ্ঠীর দিন আবাহন ও বোধন সারার পরে সপ্তমীর দিন সকালে কলাবৌ স্নানে যান বাড়ির পিছনের পুকুরে। তার আগে জাগপ্রদীপ জ্বালানো হয়। পুজোর দিনগুলিতে অর্নিবাণ থাকে প্রদীপ শিখা। এইদিনই সন্ধ্যায় পুজোর সময়ে কুলদেবী ধান্যলক্ষ্মীকে এনে দুর্গাপ্রতিমার পাশে বসানো হয়।আগে অষ্টমীর দিন কালীঘাটে এই বাড়ির নামে বলি দেওয়া হত। এখন সে প্রথা উঠে গিয়েছে। চৌষট্টি যোগিনীর পুজো হয় এই দিনেই।
সপ্তমীর দিন ১৭টি নৈবেদ্য, অষ্টমীর দিন ২৮টি এবং নবমীর দিন ২৯টি নৈবেদ্য দেবীকে অর্পণ করা হয়। বিরাট থালায় চুড়োর মতো করে চাল দিয়ে তার উপরে বসিয়ে দেওয়া হয় নাড়কেল নাড়ু। চারদিকে নানা উপকরণ দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হয় খুড়ি। কোনওটায় ছানা আর চিনি, কোনওটায় মেওয়া। কোনও খুড়িতে পাঁচকলাই, কোনওটিতে আবার মাখন-মিছরি। এছাড়াও দেওয়া হয় লুচি আর পায়েস। বৈকালিক ভোগেও থাকে লুচি। দশমীর দিন সকালে হয় অপরাজিতা পুজো। বিসর্জনের আগে একছড়া ধান, মিষ্টি আর মুদ্রা দিয়ে কনকাঞ্জলি হয়। বরণের সময়ে মাছ-ভাত খেয়ে বরণ করেন মেয়েরা। সেই সময়েই বেলপাতায় দুর্গানাম লিখে দেবীর চরণে দেন পরিবারের সদস্যরা।
প্রথম যখন পুজো শুরু হয়, তখন গোটা এলাকায় এটিই ছিল বড় পুজো। প্রতিবছর পুজোর সময়ে মেলা বসে যেত বাড়িতে। আশপাশের গ্রামগুলি থেকে মানুষ আসতেন পুজো দেখতে। পরেও প্রতি পুজোয় বাড়ির উঠোনে বসত যাত্রার আসর। চারণকবি মুকুন্দদাস, ছবি বিশ্বাস এবং মলিনা দেবী-সহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব এ বাড়িতে এসে অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন। এখন সে সবের পাট চুকেছে। তবু ঐতিহ্যের রং আজও অমলিন সরকার-বাড়ির পুজোয়।
তবে এ বছর করোনা পরিস্থিতিতে বদলে গিয়েছে অনেক কিছুই।সরকার বাড়ির পুজোতেও বেশ কিছু নিয়মকানুন মানা হচ্ছে। পুজোয় এ বার এই বাড়িতে প্রতিমা দর্শনে নিষেধ না থাকলেও আগের মতো ঠাকুরদালানে উঠতে পারবেন না কোনও দর্শনার্থী। পুজোর সামগ্রী পুরোহিতের হাতে দিলে তিনি সেগুলি ঠাকুরের পায়ে ছুঁইয়ে ফেরত দেবেন। আগের মত একসঙ্গে অনেকে মিলে প্রবেশও এ বার নিষিদ্ধ। মাস্ক পরে, সামাজিক দূরত্ব মেনে তবেই দেবী দর্শন করা যাবে।