আজকের দিনে আজাদ হিন্দ সরকার গড়েছিলেন নেতাজি
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ায় পর প্রথম প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন জহরলাল নেহরু ৷ কিন্তু তার বেশ কয়েক বছর আগে স্বাধীন সরকার গড়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু৷ ১৯৪৩-এর ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে প্রথম ‘স্বাধীন’ ভারতীয় সরকার গড়েছিলেন৷ সেই আজাদ হিন্দ সরকারের মন্ত্রিসভার শীর্ষে ছিলেন স্বয়ং নেতাজি ৷
গান্ধীজির বিরোধীতার মুখে পড়েও ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয়বারের জন্য ত্রিপুরা সেশনে কংগ্রেসের প্রসিডেন্ট নির্বাচিত হন নেতাজি। ওই নির্বাচনে গান্ধি পট্টভি সীতারামায়াইকে সমর্থন দেন এবং নির্বাচনের ফল শোনার পর গান্ধি জানিয়েছিলেন, পট্টভির হার আসলে তাঁরই হার। কিন্তু সভাপতি নির্বাচনে জিতেও গান্ধীর অনুগামীরা নানা ভাবে বাধা সৃষ্টি করার সুভাষ ঠিকমতো কাজ করতে পারছিলেন না। ফলে কংগ্রেস ছেড়ে দিয়ে তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেন।
এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় সুভাষ অনুভব করেন,এই রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে সুবিধা নেওয়া উচিত। তিনি মনে করতেন দেশের স্বাধীনতা নির্ভর করে অন্য দেশের রাজনৈতিক, সামরিক ও কুটনৈতিক সমর্থনের উপর। তাই তিনি ভারতের জন্য একটি সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন। সেই উদ্দেশ্যই তিনি ১৯৪১সালে ব্রিটিশ পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে ছদ্মবেশে দেশে ছেড়ে পালান ৷
সেই সময় নানা জায়গা ঘুরে অবশেষে জার্মানিতে যান৷ গঠন করেন যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে এক বাহিনী ৷ কিন্তু তিনি অনুভব করেন ভৌগোলিক কারণে অত দূর থেকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে চালান কঠিন৷ ফলে তখন নেতাজি পূর্ব-এশিয়ায় থেকে কাজ করতে চান৷ এদিকে রাসবিহারী বসু তখন জাপানে৷ নেতাজি জাপানে পৌঁছলে রাসবিহারী বসুর গড়া ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’-এর ভার তাঁর হাতে তুলে দেন৷
সেই সময় জাপান সরকার সর্বতোভাবেই এই স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতকে সাহায্য করে ব্রিটিশ-শাসনমুক্ত করতে রাজি ছিল৷ তবে সুভাষচন্দ্র জাপানকে বোঝান, শুধুমাত্র মিলিটারি কার্যক্রম করাই এক্ষেত্রে ভারতের স্বাধীনতার জন্য পর্যাপ্ত নয়,আলাদা প্রচার কার্যক্রমও দরকার৷
নেতাজি স্বাধীন সরকার গঠনের উদ্যোগ নিলেন৷ ১৯৪৩-এর ২১ অক্টোবর সিঙ্গাপুরের ক্যাথে সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে প্রতিষ্ঠিত হয় তথাকথিত প্রথম ‘স্বাধীন’ ভারতীয় সরকার ৷ সেই পূর্ণ মন্ত্রিসভার নেতৃত্বে ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু, তাঁর হাতে ছিল প্রধানমন্ত্রী দফতর ছাড়া বিদেশ ও যুদ্ধবিষয়ক দফতর৷ এছাড়া ওই সরকারে অন্যান্য মন্ত্রিরা ছিলেন এ. সি. চট্টোপাধ্যায়, লক্ষ্মী সাইগল এস. এ. আইয়ার প্রমুখ৷
রাসবিহারী বসুকে ওই সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়েছিল৷ শপথ নেওয়ার পর সে রাতেই মন্ত্রিসভার পূর্ণাঙ্গ বৈঠকে হয়েছিল৷ তারপর গভীর রাতে সিঙ্গাপুর রেডিও থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ইঙ্গ-মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন৷
এই স্বাধীন সরকারে আয়ু অবশ্য বেশিদিনের হয়নি৷ একবছর দশ মাস অস্তিত্ব ছিল এই সরকারের ৷ আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ও ভারতের মূল ভূখণ্ডের পূর্ব সীমান্ত ছিল এই সরকারের অধীন৷ ১৯৪৫-এর ৬ ও ৯ আগস্ট আমেরিকা পর পর অ্যাটম বোম ফেলায় জাপান আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়৷ এক্ষেত্রে জাপানই ছিল নেতাজির এই স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রধান সাহায্যকারী৷ জাপানের আত্মসমর্থনের জন্য এই উদ্যোগও ব্যর্থ হয়৷
প্রসঙ্গত, ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর গঠিত ‘স্বাধীন’ ওই সরকারকে স্বীকৃতি জানিয়েছিল ইউরোপ ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ৷ শুধু তাই নয় নেতাজি সুভাষের নেতৃত্বে এই সরকার ডাকটিকিটও এবং কারেন্সি নোট প্রকাশ করে ৷এই সরকারে জন্য একটি জাতীয় সংগীত হয়েছিল – ‘শুভ সুখ চৈন কী বরখা বরষে ভারত ভাগ হৈ জাগা……’৷
এই গানটি স্বরলিপি তৈরি করেছিলেন ডঃ অম্বিক মজুমদার, সংগীতের স্বরগ্রামটি তৈরি করেছিলেন ক্যাপ্টেন রাম সিং ঠাকুর এবং প্রথম গানটি পিয়নতে বাজিয়ে নেতাজিকে শোনানো হয়েছিল। তখন স্থাপিত হয়েছিল আজাদ হিন্দ ব্যাংক এবং বিদেশে দূতাবাসও স্থাপন করে৷ ওই সময় আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ পরিদর্শন করার পর নেতাজি সেখানকার নাম বদলে রেখেছিলেন ‘শহিদ’ ও ‘স্বরাজ ৷