বাংলার পট ঐতিহ্য
ভারতবর্ষে চিত্রকলার ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। সৃষ্টির একেবারে প্রথম দিকে গুহাবাসী মানুষ দেবতাকে তুষ্ট করার জন্য ছবি এঁকে যে-কলার সৃষ্টি করেছিল তারই রেশ পরম্পরা বাহিত হয়ে আজকের মানুষের হাতে হয়েছে আরো সমৃদ্ধ ও শিল্পিত। এই পরম্পরার মধ্যে ঘটে গেছে অনেক বদল, পালাবদলের ইতিহাসে অনেক ছাপ রয়ে গেছে তার রেখায়। কিন্তু এই চলমানতার মধ্যেও মূলসুর পুরোপুরি হারিয়ে যায়নি আর সেখানেই থেকে গেছে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার।
বাংলার পটগুলো নিছক ছবির ভাণ্ডার নয়। অন্যান্য জায়গার পটের সঙ্গে বাংলার পটের মৌলিক পার্থক্য হলো, এই পটগুলো গান গেয়ে পরিবেশিত হতো। তবে আকার, উপকরণ ও ছবির দিক থেকে অন্যান্য পটের সঙ্গে কিছুটা সৌসাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। আকৃতিগত দিক থেকে পট মূলত দুই প্রকার। এক. জড়ানো পট বা দীঘল পট, যেখানে আড়াআড়িভাবে কখনো বা লম্বালম্বিভাবে ছবি আঁকা থাকে। দুই. চৌকো পট বা একটি ছবি নিয়ে আঁকা পট। কালীঘাটের পট চৌকো পট হিসেবে পরিচিত, যদিও চৌকো পট আয়তাকার, বর্গাকার বা গোলাকার হয়ে থাকে। জড়ানো পট বা দীঘল পটের সঙ্গে গান যুক্ত থাকে।
পটুয়ারা গান গেয়ে পটের কাহিনি বলে যান। এই জড়ানো পট উচ্চাঙ্গের বা উৎকৃষ্ট মানের রসযুক্ত। বিষয়গত দিক থেকে পটকে পৌরাণিক লীলা কাহিনিমূলক, পাঁচ কল্যাণী বা পাঁচ মিশালি কাহিনির সংমিশ্রণ নিয়ে রচিত পট ও গোপালন বিষয়ক – এই তিনভাগে ভাগ করা যায়। পরবর্তীকালে আরো বিষয় সংযোজিত হয়। তবে কালীঘাটের পটের বিষয় বিচিত্র।
জেলাভিত্তিক পটের বিষয় আলাদা হয়ে থাকে, যেমন মেদিনীপুর জেলার পটের বিষয় বিভিন্ন। রামায়ণ থেকে সিন্ধুবধ, রামের বনবাস, সীতাহরণ, সেতুবন্ধন, লক্ষ্মণের শক্তিশেল, রাবণবধ ইত্যাদি মহাভারত থেকে দাতাকর্ণ, হরিশচন্দ্রের কাহিনি, সাবিত্রী সত্যবানের কথা, ভাগবত থেকে কৃষ্ণের জন্মকথা, ননি চুরি, কালীয়দমন, নৌকাবিহার, বস্ত্রহরণ ইত্যাদি পুরাণ থেকে শিব-পার্বতীর কথা, সতীর দেহত্যাগ, অসুর বধ, শিবের শাঁখা পরানো, মঙ্গলকাব্য থেকে মনসার কথা, বেহুলা লখিন্দরের কথা, কমলেকামিনীর কথা, শ্রীমন্ত সদাগরের কথা। তাছাড়া চৈতন্য কথা, সত্য নারায়ণের কথা, জগন্নাথের কাহিনি ও যমপট ইত্যাদি।
বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর এলাকায় বিষ্ণুপুরি পট ও বেলিয়াতোড় এলাকায় বেলেতোড়ি পট পাওয়া যায়, যার বিষয় হলো যম পট, জগন্নাথ পট। আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় সিঞ্চবোঙা, মারাংবুরু পট, দুর্গাপট, লক্ষ্মীপট, দশাবতার পট দেখানো হতো।
মুর্শিদাবাদের পটের বিষয় একই, তবে ঘরানার ছাপ আছে, নকশার কাজেও স্বাতন্ত্র্য লক্ষিত হয়। পুরুলিয়ার আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মধ্যে চক্ষুদান পট খুবই উলেস্নখযোগ্য। এই পটে দেখা যায় পটুয়ারা মৃত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে এই পট দেখাতেন, পটে ব্যক্তির চোখ আঁকা থাকত না ফলে তাঁরা বলতেন, চোখের অভাবে ব্যক্তিটি মৃত্যুলোকে খুবই কষ্ট পাচ্ছে তাই উপযুক্ত পারিশ্রমিক নিয়ে তাঁরা চক্ষুদান করে ব্যক্তির আত্মার শান্তির ব্যবস্থা করতেন। বীরভূমের পটে যমপট বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। পটে বিভিন্ন বিষয়ের শেষে যমপট থাকবেই যার বিষয় হলো মৃত্যু-পরবর্তী কর্মফল ভোগ।
এছাড়া অন্যান্য জেলায় রামলীলা বা কৃষ্ণকথা, বেহুলা-লখিন্দরের কাহিনি, শিব মাহাত্ম্য, চৈতন্যলীলা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে পটগুলো অঙ্কিত হয়েছে। অপরদিকে চৌকো পটে গান থাকে না আর বিষয়েও বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়, যেমন দুর্গা, কালী, গণেশ, লক্ষ্মী, শিব প্রভৃতি দেব-দেবী থেকে শুরু করে পশুপাখি, সবুজ রঙের বাঘ, মাছের ছবি, এমনকি উনিশ শতকের ইংরেজ আমলের নববাবু সমাজ ও তাদের ভ্রষ্টতা, পানাহার, বারবণিতা গমন ইত্যাদি নানা সামাজিক বিষয় নিয়ে এই চৌকো পট আঁকা হয়েছে।