ইস্যু নাগরিকত্ব – ঠাকুরবাড়ির অন্দরেই ক্ষোভ, বিভাজন
নাগরিকত্ব (Citizenship) আইন প্রণয়ন হওয়ার পরে মতুয়ারা (Matua) বনগাঁর বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুরকে (Shantanu Thakur) নিয়ে এলাকায় ‘বিজয় মিছিল’ করেছিলেন। সংসদে নাগরিকত্ব আইন পাশ হওয়ার পিছনে তাঁর ভূমিকা আছে বলে মানেন মতুয়া ভক্তদের অনেকেই। কিন্তু আইন পাশ হলেও কবে তা এ রাজ্যে কার্যকর হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট ঘোষণা নেই কেন্দ্রের তরফে। এই পরিস্থিতিতে অস্বস্তিতে পড়েছেন শান্তনু ঠাকুর। তাঁর হুঁশিয়ারি, “সিএএ (CAA) লাগু না হলে ভোটবাক্সে প্রভাব পড়বে।”
অন্যদিকে, এই ইস্যুতে তাঁকে কটাক্ষ করেছেন বনগাঁর প্রাক্তন সাংসদ তথা মতুয়া মহাসংঘের সভাধিপতি মমতাবালা ঠাকুর (Mamata Thakur)। তাঁর বক্তব্য, এতো দেরিতে বোধোদয় কেন হল? নিঃশর্ত নাগরিকত্বের স্বপক্ষেও জোরালো দাবি করেছেন তিনি।
নাগরিকত্ব ইস্যুতে ঠাকুরবাড়ির অন্দরেই ক্ষোভ, বিভাজন।
প্রসঙ্গ: নাগরিকত্ব আইন
শান্তনু: বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষে উদ্বাস্তু মানুষরা এসেছেন, তো সেখান থেকে একটা বৃহত্তর দাবী উঠে এসেছে। উদ্বাস্তু মানুষের দাবী ছিল পূর্ণ নাগরিকত্ব পাওয়া। দীর্ঘ সময় ধরে আমরা এই আন্দোলন করছি। রাজনীতি করা আমাদের মূল উদ্দেশ্য নয়, আমাদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারতবর্ষের এই মানুষদের আর্থসামাজিক মর্যাদা, রাজনৈতিক অধিকার, এই মানুষদের সমষ্টিগত উন্নয়নকে মাথায় রেখে আমরা মোটামুটি রাজনীতির আঙিনাতে।
এই মানুষগুলো আর কতদিন বঞ্চিত থাকবে? প্রত্যেকটা সরকারের কাছে আমরা প্রশ্ন রেখেছি, এবং বর্তমানেও আমরা প্রশ্ন রাখছি যে এরা কি শুধু ব্যবহারের পাত্র নাকি এরা বাস্তবে ভারতবর্ষের পূর্ণ নাগরিকত্ব পেয়ে ভারতবর্ষের মর্যাদা পাবে? সেটা আমাদের কাছে একটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে বর্তমানে।
মমতা: আমাকে প্রতিদিনই ঠাকুরের ভক্ত এবং পার্টির লোকেদের সাথে কথা বলতে হয়। তাদের ক্ষোভ আমরা শান্তনু ঠাকুরের সাথে দেখা করতে পারি না ১২ টা, ১ টার আগে। পরিসেবা পাচ্ছি না। ২ বছর হয়ে গেল কোন উন্নয়ন দেখাতে পারেনি। আমরা যে আশা নিয়ে ভোট দিয়েছিলাম কিছুই পাচ্ছি না। আগামীতে আমরা মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়কে (Mamata Banerjee) ভোট দিয়ে তাঁর হাত আরো শক্ত করব।
প্রসঙ্গ: রাম মন্দিরে (Ram Mandir) মতুয়াদের মাটি প্রত্যাখ্যান
শান্তনু: আমার মনে হয়না এরম কিছু ঘটেছিল, আমার মনে হয়েছে এটা নিয়ে রাজনীতি করেছে, রাজনীতি করাটাই স্বাভাবিক ব্যাপার, কারণ এতো সংখ্যক ভোট কেউ ছাড়তে চায় না। এতো সংখ্যক ভোট একটা অন্য পার্টিতে চলে যাবে সেটাও কেউ চায় না। তো সেমত অবস্থাতে একটা বড় রাজনীতি চলেছে। বাস্তবিক জায়গাটা এটা নয়। বাস্তবিক জায়গাতে সেই মাটি এবং জল গৃহীত হয়েছে ওখানে।
মমতা: আমরা তো জানি না এখানকার জল মাটি তারা পাঠাচ্ছে। মন্দিরের ট্রাস্টের যারা দায়িত্বে ছিল কোথাকার জল মাটি নেবে সেটা তো তাদের দায়িত্ব। কিন্তু ঘটা করে এসে জল মাটি চাওয়া হয়েছে সেটা কিন্তু সে কারো সাথে আলোচনা করেনি। ও যাদের নিয়ে চলাফেরা করে তাদের সাথে আলোচনা করেছে কি না আমি জানি না। তারাও বলছে আমরা জানি না। ফেসবুকে ওরা লিখেছে ওরাকান্দির কথা। ওরাকান্দি বাংলাদেশের অন্তর্গত সেখানে যদি জলমাটি চায়, সেটা পুরোটা অন্য দেশের বিষয়। কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ওখানকার প্রশাসনের কাছে তা চাইতে হবে। এরা বর্ডারে গিয়ে চেয়েছে ওরা দিয়েছে।
ফেসবুকে দিয়েছে শান্তনু ঠাকুরের স্ত্রী সোমা ঠাকুর পুকুর থেকে স্নান করে জল নিয়ে আসছে। আমি এখানে বসে ছিলাম দেখলাম আরএসএসের লোকরা ছিল, গেরুয়া পোশাক পরা। তারা স্করপিও নিয়ে এসেছিল। আমি এখানেই বসেছিলাম, দেখলাম তারা তুলে দিল তাদের হাতে। যখন নিয়ে গেল তখন তারা রিফিউজ করল। যদি চেয়ে থাকে তাহলে তাহলে রিফিউজ করার কোন কারণ নেই। আমি আইটিএ ফাইল করেছিলাম। তারা বলেছে আমরা জবাব দিতে বাধ্য নই। হয় তারা চায়নি বা সেরকমই কিছু একটা হবে।
শান্তনু ঠাকুরকে আমরা বলেছি যে যদি জল মাটি চেয়ে থাকে তাহলে তার চিঠি দেখাও। আর যদি গ্রহণ করে থাকে তাহলে একটা রিসিভড কপি থাকবে, আর রামের মূর্তি আর প্রসাদ এসেছে সেটাও দেখাও। শান্তনু ঠাকুরের যদি শততা থেকে থাকে আর যদি সত্যি এখানকার জল মাটি মন্দিরে ব্যবহার করা হয়ে থাকে তাহলে যেন তার প্রমাণ মতুয়াদের দেখায়। কতোদিন আর এভাবে চলবে? ওর অবস্থা রাখালের বাঘে খাওয়ার গল্পের মতো হবে।
প্রসঙ্গ: শান্তনুর পদত্যাগের জল্পনা
শান্তনু: দেখুন, বিষয় হচ্ছে দল ছাড়বার কথা হচ্ছে বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে এতো বড় একটা ভোট ব্যাঙ্ক, এতো মানুষ, এরা বাস্তবে কোন অবস্থান নেবে? সেই অবস্থানের পেছনে এদের অগ্রাধিকার কি আছে? এদের ভূমিকা কি আছে?
আমরা দেখেছি দীর্ঘ সময় ধরে বহু সরকার বহু প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। বাস্তবে এটা ফলপ্রসু হয়নি সমাজে। আশায় বুক বেঁধে আছি বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার এটা ইমপ্লিমেন্ট করবে। কিন্তু, সেটা দীর্ঘ সময় যেহেতু সিএএ তৈরি হওয়ার পরেও লাগু হচ্ছে না, মতুয়াদের মধ্যে একটা উদ্বিগ্নতা দেখা দিচ্ছে, যে কারণে আমি ওটা বলতে বাধ্য হয়েছি আর এদের দাবী দাওয়া নিয়েই মূলত আমার রাজনীতিতে আসা। যে সিদ্ধান্তমতে আজকে আমি পলিটিক্সে নেমেছিলাম, তাদের কথামতোই আজকে পলিটিক্সে এসেছি, যে কারণে তাদের বাদ দিয়ে কোনও কিছুই হবে না, আমি একা সিদ্ধান্ত নেব না আমি কি করবো? আগামীতে আমরা অবশ্যই জানাবো কী করবো? সেটা তখন ভাবা যাবে।
মমতা: শান্তনু ঠাকুর এটা নিজের স্বার্থের জন্যে করছে। বিলটা পাস হওয়া ৮ মাস হয়ে গেছে। আমরা জানি কোন বিল যদি পাস হওয়ার ৬ মাসের মধ্যে কার্যকরী না হয় তাহলে তা বাতিল হয়ে যায়। তারপর আবার স্ট্যান্ডিং কমিটি থেকে লোকসভা, রাজ্যসভা হয়ে নতুন করে পাস করাতে হয়। আমাদের মতুয়া সম্প্রদায়ের দাবি ছিল ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে যারা আসবে তারা সবাই এদেশের নাগরিক। তারপর যারা আসবে তারা কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়মানুসারে তথ্য জমা দিয়ে নাগরিকত্ব নেবে। কিন্তু এরা আমাদের কথা না মেনে ২০১৪ সালের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে যারা এসেছে তাদের আবেদন করার অনুমতি দিল। নাগরিকত্ব দিল না। ভুল বোঝাচ্ছে মানুষকে।
শান্তনু ঠাকুর এতদিনে বুঝলো? সে বলছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। একজন সাংসদ হয়েও সে বুঝতে পারছে না কেন্দ্রীয় সরকার কি করতে চাইছে নাগরিকত্ব নিয়ে! যখন বিল পাশ হল তখন কেন বলল না যে বিলটা আমাদের পক্ষে হয়নি! ২০২১ নির্বাচনের আগে বিজেপি তাকে যে ক্ষমতা ছিল তা ব্যবহার করতে দিচ্ছে না। তাই দেখানোর জন্যে বলছে আমি মতুয়াদের জন্যে পার্টি ছেড়ে দেব। সাংসদ পদ ছাড়বে না তুমি আর পার্টি ছেড়ে দেবে। মানুষকে আর কতো ভুল বোঝাবে তুমি? যাতে মাস গেলেই মাইনেটা ঢোকে, ইনকামটা বজায় থাকে, তাই তো! এসব ভাঁওতা মানুষ আর কতোদিন নেবে? বিজেপিতে (BJP) শান্তনু ঠাকুরের কতোটা ক্ষমতা মানুষ সেটা বুঝে নিয়েছে।
প্রসঙ্গ: একুশের নির্বাচন
শান্তনু: আমি মনে করি যে কেন্দ্রীয় সরকার যদি আমাদের আশা যদি পূর্ণ করে মতুয়া সম্প্রদায়ের ভোট তাদের পক্ষেই পড়বে। এটা ভবিতব্য। আশাপূর্ণ না হলেও সেটা ভোটবক্সেই জবাব পড়বে। সেটা পরবর্তী কথা। আমি সেটা নিয়ে যেতে চাইছি না। কিন্তু মতুয়া সম্প্রদায় একটা বড় ভূমিকা রাখে, রেখেছে বিগত সময়ে। অনেক পলিটিক্যাল পার্টি আমাদেরকে ঠিক ঘুরিয়ে ব্যবহারটা করেছে। কিন্তু, বর্তমানে মতুয়া সমাজ চাইছে না আর এই ব্যবহার করাটা।
মমতা: আমরা যেটা দেখতে পাচ্ছি, বিভিন্ন জায়গায় আমরা প্রচারে যাচ্ছি। বিশেষ করে ঠাকুরের ভক্ত অনেক মতুয়ারা আবার তৃণমূলে (TMC) ফিরে আসছে। বলছে আমরা ভুল বুঝতে পেরেছি। আমরা শান্তনু ঠাকুরের কাছে অনেক আশা নিয়ে গেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন ঠাকুর বাড়িতে আমরা ভেবেছিলাম মতুয়াদের কিছু দিয়ে যাবে। সেখানে ঠাকুরের নামটাই ঠিক করে উচ্চারণ করতে পারল না। মনে হচ্ছে আমাদের গালে একটা চড় মেরে গেল।
শান্তনু ঠাকুরের কাছে যে দাবি দাওয়া ছিল তাও পূরণ হয়নি। এখন বলছে এনআরসি হবে। আমরা কি ভারতের নাগরিক না? তাহলে ভোটের সময় আমাদের ভোটটা কেন নিলেন প্রধানমন্ত্রী? ১৩৫ কোটি ভারতবাসীর ভোট নিয়ে যখন সে সাংসদে বসল প্রধানমন্ত্রী হল, তখন তো সে বলেনি যে আগে নাগরিক হও তারপর ভোট দাও। এখন বলছে তোমরা আবেদন করতে নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্যে। তাহলে এখন আমরা যারা ভারতে ভোট দিচ্ছি তারা কারা? শান্তনু ঠাকুর, প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রশ্ন মতুয়ারা কারা? এখন বলছে মতুয়াদের জন্যে পার্টি ছেড়ে দেব। তাহলে পার্টিই যদি ছাড়বে তাহলে সাংসদ পদটা ছাড়। তারপর আমরা বুঝে নেব তুমি সত্যি কথা বলছ কি না!