গণি খান প্রকৃত অর্থেই ছিলেন জননেতা
নশ্বর দেহে তিনি নেই। কিন্তু তিনি আজও রয়েছেন। তিনি রয়েছেন তাঁর আদর্শ, তাঁর কর্মকাণ্ডের মধ্যে। তিনি রয়েছেন মালদার জেলার মানুষের মনের মধ্যে। মৃত্যুর পর কেটে গিয়েছে এক দশকের বেশি সময়। কিন্তু এখনো শুধু মালদা নয়, সারা বাংলার গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশের মানুষের কাছে সম্মান প্রাসঙ্গিক। কংগ্রেসি ঘরানার রাজনীতিতে আজীবন বিশ্বাসী হলেও উন্নয়নের কাজে কখনো বিচার করেননি দল বা মতের পার্থক্য। তাই তিনি সকলের কাছেই ছিলেন প্রকৃত জননেতা। সকলের প্রিয় বরকতদা।
বর্তমানে সারা দেশ জুড়েই চলছে বিভাজনের রাজনীতি। ধর্মের নামে, জাতির নামে মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করে রাজনীতি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বেশকিছু রাজনৈতিক দল। সেইসব কিছুর ঊর্ধ্বে গণি খান ছিলেন একেবারেই নির্বিরোধী মানুষ। সাম্প্রদায়িকতা কখনো তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নয়, উন্নয়নই তাঁর জীবনের মূল মন্ত্র। সেই আদর্শে তিনি অবিচল থেকেছেন আজীবন। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তাই মালদার প্রায় সমস্ত দল থেকে শুরু করে আপামর জনসাধারণ তাঁর অভাব অনুভব করছে প্রকটভাবে। কংগ্রেসের এই দুর্দিনে তাঁর অনুপস্থিতি ব্যাথিত করে কংগ্রেসের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে দলের সকল শুভানুধ্যায়ী।
আবু বরকত আতাউর গণি খান চৌধুরী বা এবিএ গণি খান চৌধুরী নয়, সারা মালদার মানুষের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন বরকতদা নামেই। ১৯২৭ সালের ১ নভেম্বর মালদা জেলার কোতুয়ালিতে তাঁর জন্ম। বাবা খান বাহাদুর আবু হায়াত বরকত খান চৌধুরী। ব্রিটিশ শাসনকালে মালদা জেলার প্রভাবশালী জমিদার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। মালদা জেলার শিক্ষাজীবন শেষ করার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হন। আইনের ডিগ্রি লাভ করেন লণ্ডন এবং জেনেভা থেকে।
ব্রিটিশ শাসনের অধীনতামুক্ত হয়ে ভারত স্বাধীন হলেও কোতুয়ালি পরিবারের গুরুত্ব কিন্তু ইংরেজবাজার বা জেলার মানুষের কাছে কমেনি। জনসংযোগে এই পরিবারের গুরুত্ব কোনো অংশেই কিমি. ছিল না। এই পরিবারের ছেলে গণি খান যে রাজনীতিতে মানুষের কাছে মর্যাদা পাবেন, সেই বিষয়ে কোনো সন্দেহ ছিল না। ১৯৫৭ সালে কালিয়াচকের সুজাপুর বিধানসভা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিধায়ক নির্বাচিত হন। সেই সঙ্গে হন রাজ্য মন্ত্রী সভার সদস্য। সুজাপুর থেকে বিধায়ক হিসাবে রাজনৈতিক জীবন শুরু করলেও তার জনপ্রিয়তা এক সময় সারা দেশ ছুয়েছিল। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত রাজ্যের কংগ্রেসি মন্ত্রীসভাতেও তিনি সদস্য ছিলেন।
প্রথম সাংসদ নির্বাচিত হন ১৯৮০ সালে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। টানা আটবারের জন্য সাংসদ হয়েছেন মালদা থেকেই। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়েছেন একাধিকবার। কেন্দ্রীয় কয়লা ও জলসম্পদ দপ্তরের মন্ত্রীর দায়িত্ব সামলেছেন নিষ্ঠার সঙ্গে। ইন্দিরা গান্ধির আমলে তাঁকে রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। মন্ত্রিত পাওয়ার পর মালদার জন্য তিনি যা করেছেন, তার জন্য মানুষের হৃদয়ে চিরকাল অমর হয়ে থাকবেন । জেলার মানুষ যাতে সহজে রেল পরিসেবা পায়, তার জন্য একসময় গড়ে তুলেছিলেন মালদা টাউন স্টেশন। এই স্টেশন থেকে বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় লাখো মানুষ যাতায়াত করেন। স্টেশনে আসা মানুষজন সহ শহরের মানুষ যাতে চিকিৎসা পরিসেবা পান, তার জন্য টাউন স্টেশনের সামনেই রেল হাসপাতাল গড়ে ওঠে তাঁর হাত ধরেই। এছাড়াও মনোরঞ্জনের সুবিধার্থে গড়ে তোলা হয়েছিল রেল পার্ক।
কেন্দ্রীয় সেচ ও জলপথ দপ্তরের মন্ত্রী থাকার সময় তিনি গঙ্গার পাড় বাঁধাতে তিনটি বাঁধ তৈরি করে দেন। এর মধ্যে একটি বাঁধ গঙ্গার ভাঙনে তলিয়ে গেলেও রাজনগরের বাঁধ সহ সদুল্লাপুর থেকে অমৃতি এবং ফরাক্কার বাঁধটি এখনো প্রতি বছর বন্যার হাত থেকে কালিয়াচকের মানুষজনকে বাঁচিয়ে চলেছে। এছাড়াও মালদা জেলা সহ কালিয়াচকের গ্রামীণ অঞ্চলে বিদ্যুত পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়াত গণি খানের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
আধুনিক কালিয়াচক গঠনের ক্ষেত্রে গণিখানের ভূমিকার কথা এখনও একবাক্যে স্বীকার করে নেন কালিয়াচকের সর্বস্তরের মানুষ। একসময় তাঁর সঙ্গে রাজনীতি করতেন যে মানুষগুলি, তাঁরা এখনো ভুলতে পারেন না কালিয়াচক তথা জেলার উন্নয়নে গণি খানের ভূমিকার কথা।