কেমন ছিল সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় এবং ইন্দিরা গান্ধীর সম্পর্ক?
দেশে জরুরি অবস্থার দুঃস্বপ্নের স্মৃতি-রোমন্থন শুরু হলেই একজন বাঙালির নাম অনিবার্য ভাবে উঠে আসে৷ তাঁর গায়েই লাগিয়ে দেওয়া হয় দোষীর তকমা এবং তাঁকে তুলে দেওয়া হয় ইতিহাসের কাঠগড়ায়৷ তিনি সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়৷
তাঁর আত্মজীবনীর প্রথম পর্বে প্রণব মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘অনেক পরে ইন্দিরা গান্ধী আমাকে বলেছিলেন দেশে অভ্যন্তরীণ গোলযোগের মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা চালু করার জন্য যে সংবিধানেই সংস্থান আছে, সে কথা তিনি জানতেনই না৷ বিশেষ করে ৭১-এর ভারত-পাক যুদ্ধের পরবর্তীতে দেশে তখন যেহেতু আর একটা জরুরি অবস্থা জারি ছিলই৷ এমন একটি সাংবিধানিক প্রবিধানের দিকে ইন্দিরার দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়ে ছিলেন সিদ্ধার্থবাবুই৷’
জরুরি অবস্থা নিয়ে সদ্য প্রকাশিত আর একটি বইয়ে (দ্য এমারজেন্সি এ পারসোনাল হিস্ট্রি) সাংবাদিক কুমি কাপুর সিদ্ধার্থ রায়ের ভূমিকা প্রসঙ্গে প্রণবববাবুর চেয়েও এক-ধাপ এগিয়ে গিয়ে দাবি করেছেন পশ্চিমবঙ্গের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী নাকি ১৯৭৫-এর জানুয়ারিতেই (অর্থাত্ জরুরি অবস্থা জারি হওয়ার ছয় মাস আগেই) ইন্দিরাকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছিলেন৷ দাবির সমর্থনে অ-প্রকাশিত সিদ্ধার্থবাবুর একটি হাতে লেখা চিঠির প্রতিলিপি মুদ্রিত হয়েছে বইটিতে৷
চিঠিটি এই রকম—
প্রিয় ইন্দিরা,
বড়ুয়ার (তত্কালীন কংগ্রেস সভাপতি দেবকান্ত বড়ুয়া যিনি ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা’ স্লোগান তুলে সে সময় চাটুকারিতার বিশ্ব-রেকর্ড করেছিলেন) বাড়ির মিটিং এই শেষ হল৷ আমার ইচ্ছে ছিল, কয়েকটি জরুরি কথা তোমাকে এক্ষুনি জানাব, কিন্তু শুনলাম তুমি কোনও একটা সরকারি নৈশভোজে ব্যস্ত আছ৷ সে জন্যই আমি তড়িঘড়িতে লেখা এই নোটটি তোমাকে পাঠাচ্ছি৷
কিচ্ছু করা হয়নি— কোনও তালিকা তৈরি হয়নি — এক্কেবারে কিছুই নয়৷ দেশের পরিস্থিতি সত্যিই কতটা ভয়াবহ সে সম্পর্কে এখানকার অনেকেরই বিন্দু-বিসর্গ ধারণা নেই৷ কিন্তু বড়ুয়া ও রজনী (রজনী প্যাটেল, মুম্বই কংগ্রেসের তত্কালীন সভাপতি, কংগ্রেসের ফান্ড-রেইজার) দু’জনেই সহযোগিতা করেছে, ঠিক হয়েছে আজ রাতের মধ্যেই গোখেল (তত্কালীন আইনমন্ত্রী) প্রস্তাবিত অর্ডিনান্সের একটি খসড়া তৈরি করে ফেলবে৷ গাইড-লাইনগুলি কী হবে আমরা মোটামুটি তা স্থির করে ফেলেছি, ঠিক হয়েছে কাল সকাল ৯টায় (উফ) গোখেলের বাড়িতে আমরা আবার বসব৷ যাতে একটা তৈরি হওয়া কিছু নিয়ে আমরা তোমার কাছে আসতে পারি৷
আমি ওমকে (ওম মেহতা, তত্কালীন স্বরাষ্ট্র দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী) এই কাজটা করতে বলেছি৷ আমি মনে করি তোমার উচিত এই কাজটা অবিলম্বে করে ফেলার জন্য ব্রহ্মানন্দ রেড্ডিকে (স্বরাষ্ট্র দফতরের পূর্ণমন্ত্রী) নির্দেশ দেওয়া৷ পাশাপাশি দেশের সব কয় জন কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রীকে অবিলম্বে একটি গোপন টেলেক্স-বার্তা পাঠানো প্রয়োজন যাতে নির্দেশ দেওয়া থাকবে প্রত্যেকেই যেন যে যার রাজ্যের সব কয়েক জন গুরুত্বপূর্ণ আনন্দমার্গী ও আর এস এস নেতার তালিকা জরুরি ভিত্তিতে তৈরি করে রাখে৷ অর্ডিনান্সের কথা কাউকে বলার কোনও প্রয়োজন নেই, শুধু তালিকা তৈরির কথা বলাটাই যথেষ্ট৷ গোটা পরিকল্পনাটির সার কথা হল অর্ডিনান্স তৈরি হয়ে যাওয়ার পরে একেবারে সঙ্গে সঙ্গে তা কার্যকর করা৷ আর যে করে হোক আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এই অর্ডিনান্স তৈরি করে ফেলতে হবে৷ আমি আশা করি অর্ডিনান্সে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর পেতে কোনও অসুবিধে হবে না৷ একই সঙ্গে হয় কাল সন্ধ্যায় অথবা রাতে বা তেমন অসুবিধে হলে পরশু দিন সকালে মন্ত্রিসভার একটি বিশেষ বৈঠক ডাকতে হবে অর্ডিনান্সটি অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার জন্য৷ (অর্ডিনান্স তৈরিতে যদি ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায় একমাত্র তা হলেই মন্ত্রিসভার বৈঠকের জন্য পরশু সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যেতে পারে)৷
আগামী কালের মিটিংয়ে তুমি বিশেষ ভাবে জোর দেবে যাতে সন্ধ্যার মধ্যেই অর্ডিনান্স রেডি হয়ে যায়৷ আবার মনে করিয়ে দিচ্ছি, আজ রাতেই তুমি অবশ্য ব্রহ্মানন্দ রেড্ডিকে টেলিফোন করে বিষয়টি জানাবে৷
সিদ্ধার্থ
পুনঃ— আমি বাড়িতেই আছি, ইচ্ছে করলে তুমি যে কোনও সময় আমাকে ফোন করতে পার৷
ধরে নেওয়া যেতে পারে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ইন্দিরা খুব একটা ভুল বলেননি৷ অর্থাত্ অভ্যন্তরীণ জরুরি ব্যবস্থা সংক্রান্ত সাংবিধানিক বন্দোবস্তের কথা তাঁর জানা ছিল না৷ কিন্তু তাঁর চরম সমালোচকও কোনও দিন এ প্রশ্ন তোলেননি৷ ইন্দিরার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করা অনেক আমলাই পরবর্তীতে তাঁদের স্মৃতি-কথায় অকপটে লিখেছেন, জরুরি সরকারি ফাইলও তিনি গভীর মনোনিবেশ করে পড়তেন না৷ ছোটো-বড়ো সব ব্যাপারেই নির্ভর করতেন আমলা অথবা উপদেষ্টাদের মতামতের উপর৷
১৯৭৪-৭৫ সালে সেই সব ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টাদের অন্যতম ছিলেন অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়৷ ব্যক্তিগত স্তরে ইন্দিরার সঙ্গে সিদ্ধার্থবাবুর সম্পর্ক কতটা গভীর ছিল তার প্রমাণ আছে সম্বোধন থেকে চিঠিটির ছত্রে ছত্রে৷ তত্কালীন কংগ্রেস নেতা-মন্ত্রীদের মধ্যে সিদ্ধার্থবাবুই একমাত্র যিনি প্রধানমন্ত্রীকে নাম ধরে ডাকতে পারতেন, চিঠিতে লিখতেন ইন্দিরা, ব্যক্তিগত আলোচনায় ইন্দু৷
কুমি কাপুরের উদ্ধার করা চিঠিটি পড়লে মনে হয় না দেশের একটি সামান্য অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী লিখছেন দেশের দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রধানমন্ত্রীকে৷ দেবকান্ত বড়ুয়ার মতো কংগ্রেসের তাবড় নেতারা যে সময় স্তাবকতায় বিগলিত, সে সময়ও প্রাতিষ্ঠানিক শিষ্টাচারকে দূরে সরিয়ে রেখে সিদ্ধার্থবাবু প্রধানমন্ত্রীকে দেখেছেন বন্ধু হিসেবেই৷
চিঠিটির ভাষা কিংবা ছত্রে ছত্রে দেওয়া উপদেশাবলী পড়লে মনে হয় এ যেন ছাত্রীকে লেখা কোনও মাস্টারমশায়ের বক্তব্য, প্রধানমন্ত্রীকে লেখা মুখ্যমন্ত্রীর নোট নয়৷ একটি অর্ডিনান্স আনার জন্য কী কী করণীয় স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে যখন সে সব কর্তব্যের কথা পাখি-পড়ার মতো করে বোঝাতে হয় তখন আরও বেশি করে মনে হয় প্রণববাবুর মন্তব্যটি সম্পূর্ণ ঠিক৷