বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

অশ্বিনী কুমার দত্ত – বিস্মৃত এক সংগ্রামী

November 7, 2020 | 2 min read

পরাধীন ভারতবর্ষের মুক্তিসংগ্রামের আন্দোলনে, যারা অগ্রগণ্য ছিলেন তাদের অন্যতম অশ্বিনী কুমার দত্ত। ১৮৫৬ সালে বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বাটাজোরে জন্ম। তৎকালীন উচ্চ শিক্ষিত রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তিনি। বরিশালে বসেই কাঁপিয়ে দিয়েছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত।

তখন জাতীয় কংগ্রেসের (১৮৮৫) যাত্রা শুরু হয়নি। অশ্বিনী দত্ত স্থানীয় গায়ককে সঙ্গী করে বরিশালের বাজার রোড, হাটখোলাসহ জনবহুল এলাকায়, খাল ও নদীর ধারে গানের সঙ্গে একটি কাঠের বাক্সের ওপর দাঁড়িয়ে সামাজিক, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে বক্তব্য দিতেন। বরিশালের নানা সমস্যা, দেশের পরিস্থিতি তিনি প্রচার করে জনমানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। এভাবেই ‘জনসাধারণের সভা’ নামে এক রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগ (১৮৮৬) পরে পরিণতি লাভ করে। অশ্বিনী দত্তের এই জন গণমুখিতা ছিল অসাধারণ।

জাতীয় নেতা হতে পারতেন অশ্বিনী দত্ত। কিন্তু তিনি চাইলেন বরিশালের মানুষের ভালো মন্দের সঙ্গে জড়িয়ে আঞ্চলিক নেতা হয়ে থাকতে। তাই রাজনীতির সঙ্গে জনসেবা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে বরিশালকে বদলে দিতে চাইলেন। ১৮৮৪ সালের ২৭ জুন ‘সত্য-প্রেম-পবিত্রতা’কে মহা মন্ত্র করে পিতা ব্রজমোহন দত্তের নামে তিনি প্রতিষ্ঠিত করলেন ব্রজমোহন বিদ্যালয়। স্কুল স্থাপনের ৪র্থ দিনের মধ্যেই স্কুলের ছাত্রসংখ্যা ৩ শত ছাড়িয়ে যায়। ‘সত্য-প্রেম পবিত্রতা’ শুধু কাগজের বাণী ছিল না। বিদ্যালয়ের পতাকায়, প্রবেশ পথে, অধ্যয়ন কক্ষে সর্বত্র এটি প্রচারিত হতো। শিক্ষার্থীরা সত্যিকার অর্থেই ‘সত্য-প্রেম-পবিত্রতা’ ভাবনায় জীবনভর চালিত হতো।

ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে শুধু শিক্ষা গৃহ নয়, এখানে নীতি শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হতো। স্কুলটি পরিদর্শনে এসে সুপন্ডিত ক্যানিংহাম মন্তব্য করেছিলেন, ‘বঙ্গদেশে ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের মতো উৎকৃষ্ট বিদ্যালয় থাকিতে বাঙালি ছাত্ররা অক্সফোর্ড বা কেম্ব্রিজে কেন যায় আমি তাহা বুঝি না।’ দরিদ্র-বান্ধব সমিতি, বান্ধব সম্মিলনী, আশ্বাসী সম্প্রদায়, কৃপালু সম্প্রদায় সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষকেরা ছাত্রদের নিয়ে, রোগীর সেবা, দরিদ্রকে সহায়তা ও বিপন্নকে উদ্ধারের অবিরাম চেষ্টা হতো। স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ শিক্ষা কার্যক্রমে অর্থের অভাবে পড়াশোনা করতে না পারলে এগিয়ে আসত ব্রজমোহন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। 

অশ্বিনী দত্তের প্রভাবে যারাই এসেছেন, দেশপ্রেমিক সোনার মানুষে পরিণত হয়েছেন তারাই। এর উদাহরণে চারণ কবি মুকুন্দ দাস রূপে গড়ে তোলে যাত্রার মাধ্যমে লোক শিক্ষার আহ্বান জানান। অশ্বিনী দত্তের ভাষায়, ‘আমরা যে সব বক্তৃতা করে বেড়াচ্ছি তা যদি কেউ যাত্রা আকারে গ্রামে গ্রামে প্রচার করে, তাহলে তা আমাদের এই রূপ সভা বা বক্তৃতার চেয়ে অনেকটা কার্যকরী হয়’। মুকুন্দ দাস নেমে পড়লেন দেশের কাজে। গ্রামে গ্রামে মুকুন্দের যাত্রাপালার মাধ্যমে স্বদেশ চেতনার জাগরণের ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল। ব্রিটিশরাজ প্রমাদ গুনলেন। যেখানেই মুকুন্দ দাস সেখানেই ১৪৪ ধারা ঘোষিত হলো। তারা বই বাজেয়াপ্ত হলো- এক সময়ে গ্রেপ্তার করল তাকে।

১৯২১ সালে বরিশালে কংগ্রেসের আরেকটি প্রাদেশিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মহাত্মা গান্ধী সে সময়ে আসতে না পারলে পরের বছর তিনি জনসভা করেন। এ সময় অশ্বিনী দত্তের বাসভবনেও মহাত্মা গান্ধী অশ্বিনী কুমার দত্তের সঙ্গে দেখা করেছেন। সে সময়ে বরিশালের ব্রিটিশ বিরোধিতা ছিল সারা ভারতবর্ষের মতো প্রবাদ সম। মহাত্মা গান্ধীর উচ্চারণে-‘সমগ্র ভারত যখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন তখন বরিশাল সদা জাগ্রত’।

অশ্বিনী কুমার আধুনিক বরিশালের রূপকার। বরিশালের প্রতি ভালোবাসায় তিনি বলেছিলেন ‘মরার পর যেন আবার জন্ম গ্রহণ করি এই বরিশালের মাটিতে।’ কিন্তু তিনিই আজ বিস্মৃত তাঁর ভূমে।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Aswini Kumar Dutta

আরো দেখুন