কম আসনেও মুখ্যমন্ত্রী সেই নীতীশ, বিজেপির অভিসন্ধি নিয়ে তুঙ্গে জল্পনা
সোমবার বিকেলে যিনি পটনায় সপ্তম বার বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর পদে শপথ নিলেন, তিনি কি আসলে বিজেপি-রচিত ‘চক্রব্যূহে’ ঢুকে পড়লেন?
সামান্য ব্যবধানে বিহারে এনডিএ (NDA) ক্ষমতা দখল করার পর বিজেপি তাদের ‘প্রতিশ্রুতি’ রেখে জনতা দল ইউনাইটেড (জেডিইউ) নেতা নীতীশ কুমারকে মুখ্যমন্ত্রী করল ঠিকই। কিন্তু সেই সরকারে তাঁকে কার্যত চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা হল শরিক বিজেপি-র প্রতিনিধি দিয়ে। বিহারের রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহালরা মনে করছেন, তিনবারের উপমুখ্যমন্ত্রী সুশীল মোদীকে পদ থেকে সরানো, বিজেপি-র দু’জন উপমুখ্যমন্ত্রী নিয়োগ তারই অঙ্গ। শোনা যাচ্ছে, স্পিকার পদটিও নিজেদের হাতে রাখতে চাইছে বিজেপি। এ দিন দেখা গেল, গত বারের বারের স্পিকার জেডিইউ-এর বিজয় চৌধুরী-ও শপথ নিলেন। শেষ পর্যন্ত যে দিকে পরিস্থিতি যাচ্ছে, তাতে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মনে হচ্ছে, এর পিছনে কাজ করছে মোদী-শাহ জুটির সুদূরপ্রসারী অঙ্ক। ওয়াকিবহালদের বক্তব্য, বিহারের অভ্যন্তরীণ জাতপাতের রাজনীতির কথা মাথায় রেখে দলের বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভেবেই ঘুঁটি সাজাতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ।
পাশাপাশি, বিহারের পরেই বাংলার বিধানসভা (West Bengal Assembly Election 2021) ভোট আসছে। বিহারে বেশি আসন জেতায় বিজেপি মনে করছে, তার প্রভাব বাংলায় পড়বে। ঠিক যে ভাবে বাংলার ‘নীলবাড়ি’ দখলের ভোটে বিজেপি-র ফলাফল ইতিবাচক হলে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে নীতীশের ভবিষ্যতে।
ভোটের ফলাফল বলছে, শক্তির বিচারে বিহারে বিজেপি (BJP) (৭৪ জন বিধায়ক) অনেকটা এগিয়ে জেডিইউ (৪৩ জন বিধায়ক)-এর থেকে। সেই নিরিখে বিজেপি থেকে ২২ জন মন্ত্রী হওয়ার কথা বিহারে। পক্ষান্তরে, নীতীশের দলের মন্ত্রীর সংখ্যা হওয়ার কথা ১২ জন। তবুও সেখানে ‘ধীরে চলো’ নীতি নিয়ে দলকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে চাইছেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। বঙ্গ বিজেপি-র এক শীর্ষনেতার পর্যবেক্ষণ, ‘‘বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব চান দলই সরকার চালাবে। সেখানে ‘ব্যক্তি’ গুরুত্বহীন। সেইজন্যই নীতীশকে ঘিরে দেওয়ার পরিকল্পনা।’’
প্রথম জল্পনা, বিহারের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে নীতীশকে ক্রমাগত ‘অপ্রাসঙ্গিক’ করতে চায় মোদী-শাহ জুটি। সুশীল মোদীকে (Sushil Modi) উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ না দেওয়া সেই বৃহত্তম পরিকল্পনারই অঙ্গ। কারণ, প্রথমত, তিনবার নীতীশের উপমুখ্যমন্ত্রী থাকায় সুশীল-নীতীশ সম্পর্কের ‘রসায়ন’ পরীক্ষিত। দ্বিতীয়ত, নীতীশকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরানোর সময় সুশীল উপমুখ্যমন্ত্রী থাকলে তিনিই মুখ্যমন্ত্রীর হওয়ার দাবিদার হতে পারেন। প্রসঙ্গত, বিহারের সরকার কী ভাবে তৈরি হচ্ছে, তা স্পষ্ট হওয়ার পরেই সুশীল তাৎপর্যপূর্ণ টুইট করেছেন, ‘বিজেপি এবং সঙ্ঘ পরিবার আমার ৪০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এত কিছু দিয়েছে, যা আর কারও ভাগ্যে জোটেনি। আমাকে ভবিষ্যতে যে দায়িত্ব দেওয়া হবে, তা পালন করব। দলের কর্মীর পদ আমার কাছ থেকে কেউ ছিনিয়ে নিতে পারবে না’।
জল্পনা আরও রয়েছে। যার উৎস দু’জন উপমুখ্যমন্ত্রী নিয়োগ করা। ওই দুই পদে যাঁদের নিয়ে আসা হল, তাঁরা হলেন কাটিহারের চারবারের বিধায়ক তারকিশোর প্রসাদ এবং বেতিয়ার বিধায়ক রেণু দেবী। তারকিশোরকেই আবার পরিষদীয় দলনেতা হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছে। শেষমেশ নীতীশকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা সফল হলে এই দুই ‘পিছিয়ে-পড়া’ সম্প্রদায়ের কোনও একজনকে ওই আসনে বসানো হতে পারে। পাশাপাশি, বৈশ্য সম্প্রদায়ের তারকিশোর এবং নোনিয়া সম্প্রদায়ের রেণুকে উপমুখ্যমন্ত্রী করে দুই সম্প্রদায়ের কাছেই ‘বার্তা’ দিল বিজেপি। জল্পনা আরও যে, পটনা সাহিব বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী সাতবারের বিধায়ক বর্ষীয়ান নন্দকিশোর যাদবকে গুরুত্বপূর্ণ স্পিকার পদে আনতে চাইছেন বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। সেক্ষেত্রে যাদব সম্প্রদায়ের কাছেও ইতিবাচক বার্তা দেওয়া যাবে। তবে নীতীশের (Nitish Kumar) পরিবর্ত খুঁজতে গিয়ে বিজেপি-র শীর্ষনেতৃত্ব বর্তমানে কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিত্যানন্দ রায়ের কথাও ভাবছেন বলে দলীয় সূত্রের খবর। ঘটনাচক্রে, যিনি অমিত শাহের ‘আস্থাভাজন’।
বস্তুত, বিহারের ফলাফলের পর এ বার প্রত্যাশিত ভাবে পশ্চিমবঙ্গ ভোট এবং তৎসংক্রান্ত ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়েও চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে বিজেপি-র অন্দরে। দলের একাংশের বক্তব্য, তার উপরেও নীতীশের মুখ্যমন্ত্রিত্ব খানিকটা নির্ভরশীল। ‘নীলবাড়ির লড়াই’-এ বিজেপি জিতলে বিহারে ‘অভিমন্যু’র পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে।