স্বাস্থ্য বিভাগে ফিরে যান

করোনা ভ্যাকসিন কতটা নিরাপদ?

December 21, 2020 | 5 min read

বিশ্বকাপের সময় আমাদের অনেক অজানা অচেনা খেলোয়াড়, অল্প-পরিচিত টিম, খেলার টুকিটাকি নিয়ে জ্ঞান বেড়ে যায়। তেমনই এই অতিমারীর ১০ মাসে বেশ কিছু শব্দ আমাদের দৈনন্দিন অভিধানে ঢুকে পড়েছে। আরটিপিসিআর, অ্যান্টিজেন, কোয়ারেন্টাইন  যেমন আর অজানা কথা নয়, তেমনই সিরাম ইনস্টিটিউট, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, ভারত বায়োটেকের মতো দেশি-বিদেশি ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারকের নামের সঙ্গেও আজ আমরা পরিচিত। রোজই কোনও না কোনও ভ্যাকসিনের অগ্রগতি নিয়ে খবর এখন রুটিন হয়ে গিয়েছে। 

বহুজাতিক সংস্থা ফাইজার এবং মর্ডানার নতুন প্রযুক্তির টিকা যেমন সবার নজর কেড়েছে, তেমনই ভারতবাসী এও উপলব্ধি করেছেন যে এই অত্যাধুনিক টিকা ব্যবহারের পরিকাঠামো  আমাদের দেশে নেই। সরকারও নানা বৈজ্ঞানিক, ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক সমীকরণ মাথায় রেখে টিকার বরাত দিচ্ছে। 

১৬০ কোটি ডোজ

মার্কিন ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসেব অনুযায়ী, এখনও অবধি ভারত সব মিলিয়ে ১৬০ কোটি ভ্যাকসিন ডোজ কেনার চুক্তি করেছে। বিখ্যাত ভাইরাস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শাহিদ জামিলের মতে, মাথাপিছু দু-ডোজ করে ধরলে প্রায় ৮০ কোটি ভারতবাসীর টিকাকরণ সম্ভব হবে। এর মধ্যে ৫০ কোটি হল অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার ‘কোভিশিল্ড টিকা’ যা প্রস্তুত করছেন পুনের সিরাম ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া এবং ১০ কোটি ডোজ হল রাশিয়ার ‘স্পুটনিক-ভি’ ভ্যাকসিন, যা দেশে তৈরি করছেন হায়দরাবাদের ডাঃ রেড্ডির ল্যাব। তবে, এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি অর্ডার দেওয়া হয়েছে মার্কিন কোম্পানি ‘নোভাভ্যাক্স’-এর টিকা ‘কোভোভ্যাক্স’-এর ১০০ কোটি ডোজ! 

কালো ঘোড়া কোভোভ্যাক্স

আমেরিকার মেরিল্যান্ডে অবস্থিত ছোট কোম্পানি ‘নোভাভ্যাক্স’-এর টিকা নিয়ে এই সংবাদপত্রে লেখা হলেও, কেন জানি না, দেশে খুব বেশি কথা হয়নি। অথচ সংখ্যাগত দিক থেকে এর ওপরেই এখন ভারতবাসী অনেকাংশে নির্ভরশীল। কারণ এই টিকার ভারতীয় অনুরূপ কোভোভ্যাক্স-এর ১০০ কোটি ডোজ কেনা হচ্ছে। এবার প্রশ্ন হল কেন এই টিকাটি বেছে নেওয়া হল? বৈজ্ঞানিক দিক থেকে দু’টি বড় কারণ আছে। এই টিকা একটি নতুন প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এতে নিষ্ক্রিয় ভাইরাস বা ডিএনএ বা আরএনএ ব্যবহার করা হচ্ছে না। তার জায়গায় এখানে আছে পিএস-৮০ নামের একটি বিশেষ অণু। 

পিএস-৮০-এর কাঠামো ঠিক একটা নল বা পাইপের মতো এবং সেই আণবিক নলের ওপর বিজ্ঞানীরা সাজিয়ে দিয়েছেন করোনা ভাইরাসের বিখ্যাত (কুখ্যাতও বলতে পারেন) স্পাইক প্রোটিন। এক একটি পিএস-৮০ নল থেকে বেরিয়ে আছে ১৪টি স্পাইক প্রোটিন। এর বৈজ্ঞানিক নাম ‘ন্যানোপার্টিকল ভ্যাকসিন’। প্রথমে বাঁদর ও পরে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবকদের উপর পরীক্ষায় দেখা গিয়েছে কারও মধ্যেই কোনও চিন্তাজনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ধরা পড়েনি। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল যে আজ পর্যন্ত যতগুলি পরীক্ষামূলক টিকার খবর প্রকাশিত হয়েছে, তাদের মধ্যে নোভাভ্যাক্সের ন্যানোপার্টিকল ভ্যাকসিন সবচেয়ে বেশি রোগ বিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। 

শুধু তাই নয়, ফাইজার বা মর্ডানার টিকার সংরক্ষণের জন্যে যে বিশেষ ‘-৭০’ ডিগ্রি ফ্রিজার লাগে, এক্ষেত্রে তারও দরকার নেই। ২ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস অর্থাৎ আমাদের দেশের হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সাধারণত যে সব ফ্রিজ বা ফ্রিজার রয়েছে তাতেই এই ভ্যাকসিন দিব্যি থাকে। বিজ্ঞানী ও বাণিজ্যিক দুই মহলই এই খবরে আশান্বিত এবং সেই জন্যেই ফলাফল প্রকাশ হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই আমেরিকা, মেক্সিকো, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া এদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। ব্রিটেনেও ১৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা। 

নোভাভ্যাক্সের সমস্যা যে নেই তা নয়। ছোট কোম্পানি, তাই বড় স্কেলে ভ্যাকসিন প্রস্তুত করতে অন্য সংস্থার সঙ্গে হাত মেলাতে হয়েছে। তাতে তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষার জন্যে দেরি হচ্ছে। অবশ্য, ভারতের বৃহত্তম সংস্থা সিরাম ইনস্টিটিউট এদের সঙ্গে এখন চুক্তি করেছে। ট্রায়ালও শুরু হয়েছে কলকাতার ট্রপিক্যাল মেডিসিন সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। আশা করা হচ্ছে ১০০ কোটি ডোজ আমাদের দেশেই তৈরি হবে।

বহু আলোচিত কোভিশিল্ড

এর সঙ্গে আছে সিরাম ইনস্টিটিউটে তৈরি অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকা’র ‘কোভিশিল্ড’ টিকা। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে প্রকাশিত তাদের গবেষণাপত্র থেকে জানা যায় যে সম্মিলিত দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায় পরীক্ষামূলক টিকাকরণে ৫৬০ জন ইংরেজ ও ব্রাজিলিয় স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১৬০ জনের বয়স ৫৬ থেকে ৬৯-এর মধ্যে এবং আরও ২৪০ জনের বয়স ৭০-এর বেশি। বয়স্করা যেহেতু করোনায় বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন, তাই দেখা হচ্ছিল এই টিকা তাঁদের কতটা সুরক্ষা দিতে পারে। ফলাফল আশ্বস্ত করছে যে টিকাকরণের জন্যে তেমন কোনও খারাপ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। বয়স্করাও এই টিকা ভালো সহ্য করেছেন এবং যুবক থেকে বৃদ্ধ সবার শরীরেই যথেষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছিল। আরও ট্রায়াল চলছে। যেমন ভারতের ন’টি রাজ্যের ১৬০০ স্বেচ্ছাসেবকের উপর এখন কোভিশিল্ড পরীক্ষা হচ্ছে। 

তাহলে দুশ্চিন্তা কোথায়? 

ঘটনা এক। সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে এক স্বেচ্ছাসেবক ট্রান্সভার্স মায়েলাইটিস নামে একটি স্নায়ুরোগে অসুস্থ হয়ে পড়ায় অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা সব টিকাকরণ কিছুদিন বন্ধ রাখে। 

ঘটনা দুই। তৃতীয় পর্যায়ের ফলাফল যখন বের হয়, তখন দেখা যায় যে টিকাকরণের সময় একটু গণ্ডগোল হয়ে গিয়েছিল। যাঁদের বেশি ডোজ পাওয়ার কথা, তাঁরা কেউ কেউ ভুল করে কম ডোজ পেয়ে গিয়েছেন এবং সেই জন্যে আজও বিশ্লেষণে অল্প ধোঁয়াশা আছে। একইরকম চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে ভারতের দু’টি ঘটনায়। 

ঘটনা তিন। নভেম্বরে চেন্নাইয়ের এক স্বেচ্ছাসেবক দাবি করেন যে পরীক্ষামূলক কোভিশিল্ড নেওয়ার পরে তাঁর মস্তিষ্কের অসুখ দেখা যায় এবং তাই তিনি বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তিনি ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা ঠুকেছেন। এক্ষেত্রে কিন্তু সিরাম ট্রায়াল বন্ধ রাখেনি, বরং স্বেচ্ছাসেবকের অভিযোগ খণ্ডন করে পাল্টা মানহানির মামলা করে। 

ঘটনা চার। একই ধরনের ঘটনা হয়েছে ভারত বায়োটেকের  কোভ্যাকসিন টিকার ক্ষেত্রে। ভারত বায়োটেক এবং আরেক দেশীয় সংস্থা জাইডাস ক্যাডিলা থেকে টিকা প্রস্তুত ও পরীক্ষিত হলে বছরে আরও ৪০ কোটি ডোজ পাওয়া সম্ভব। কোভ্যাকসিন টিকায় প্রথমে বাঁদরদের শরীরে আশাতীত ফল দিয়েছিল। পরে এক হাজার স্বেচ্ছাসেবককে টিকা দিয়ে দেখা যায় প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। এখন ২৬ হাজারের স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে শুরু হয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষা। কিন্তু, কোম্পানির অন্যতম কর্ণধার সাক্ষাৎকারে এও জানিয়েছেন যে আগস্ট  মাসে তাঁদের প্রথম পর্যায়ের পরীক্ষার সময় এক স্বেচ্ছাসেবক অসুস্থ হয়ে পড়েন। তখন তাঁরা দ্রুত বিশ্লেষণ করে দেখেন যে ওই ব্যক্তির অসুস্থতার সঙ্গে টিকাকরণের সম্পর্ক নেই। তাই ওই সময় পরীক্ষাও থামানো হয়নি। নিয়ম মেনে সরকারকে সব জানানোও হয়েছে। 

তবে টিকাকরণ সংক্রান্ত সব বৈজ্ঞানিক তথ্য যে যত দ্রুত সম্ভব বিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠিত জার্নালে প্রকাশ করে জনসমক্ষে আনা উচিত। উপরিউক্ত ঘটনাগুলি কিন্তু এই দাবির পক্ষে জোরালো সওয়াল করছে।

কতটা নিরাপদ করোনার টিকা? 

সংখ্যার দিক থেকে বোঝাই যাচ্ছে হাজার হাজার টেস্টের মধ্যে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার সিরিয়াস কেস। আর এখনও অবধি যত পরীক্ষার ফলাফল জানা গিয়েছে, তাতে কোনও চিন্তাজনক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। 

আর সত্যি বলতে কী, সামান্য গা ম্যাজম্যাজ, একদিনের জ্বর বা দুর্বলতা বা হাত ব্যথাকে ‘সাইড এফেক্ট’ বলে না। এগুলি হল টিকা পেয়ে শরীরের রোগ-প্রতিরোধকারী ব্যবস্থার প্রতিক্রিয়া। শরীরে একটি বাইরের জিনিস ঢুকিয়ে দেওয়া হল। তার একটা প্রতিক্রিয়া তো হবেই। বাস্তবিক সেটাই তো প্রমাণ যে টিকায় যে নির্বিষ জীবাণু বা তার প্রোটিন বা ডিএনএ, আরএনএ আছে, শরীর তাকে দেখে-শুনে চিনে রাখছে। না হলে পরে আসল ভাইরাস ঢুকলে লড়বে কেমন করে? আর এটা নতুন কথাও নয়। বসন্ত টিকার আবিষ্কারক জেনারের কথা মনে আছে? ২০০ বছর আগে তাঁর টিকাকরণের সময় হালকা করে গো-বসন্ত হতো এবং সেই জন্যেই পরে কালান্তক গুটিবসন্ত পরাস্ত হয়েছিল। এখনও পর্যন্ত টিকাকরণ পরীক্ষায় এইসব সামান্য শারীরিক অস্বস্তি  একই ব্যাপার। 

অনিল ভিজ কাণ্ড!

হরিয়ানার মন্ত্রী অনিল ভিজ কোভ্যাকসিন টিকা নেওয়ার দু’সপ্তাহ পরে করোনা আক্রান্ত হতে ওই ঘটনা নিয়ে প্রচুর ‘গেল গেল’ রব উঠেছে। এটা কিন্তু চায়ের কাপে তুফান তোলা। কারণ মন্ত্রীমশাই ডবল ডোজ টিকার প্রথমটি মাত্র পেয়েছিলেন। সত্যিই সেটা যথেষ্ট অ্যান্টিবডি তৈরির পক্ষে যথেষ্ট নয়। দ্বিতীয় ‘বুস্টার’ ডোজ যে লাগে সে তো সাধারণ মানুষও জানে। তার ওপর ভদ্রলোকের বয়স ৭০-এর কাছাকাছি, সুগারও আছে। তাছাড়া, এও জানাও নেই তিনি সত্যি টিকা পেয়েছিলেন না প্লাসিবো দলের মধ্যে তিনিও একজন কি না। এই প্লাসিবো দলের স্বেচ্ছাসেবকদের শুধু স্যালাইন দেওয়া হয়। সুতরাং, তিনি আক্রান্ত হয়েছেন বলে হতাশাগ্রস্ত বা আতঙ্কিত হবার কিচ্ছু নেই। 

তবে হ্যাঁ, বোঝাই যাচ্ছে, এক বা দুই ডোজ ভ্যাকসিন (সে পরীক্ষামূলক হোক বা আসল হোক) পেলেই ধেইধেই করে মাস্ক না পরে বেরিয়ে ভিড়ে গেলে চলবে না। মনে থাকে যেন এক ধুরন্ধর ভাইরাসের বিরুদ্ধে এ এক দীর্ঘ সংগ্রাম। ঢিলে দেওয়ার জায়গা নেই।

এই প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয় বর্তমান পত্রিকায়। 

লেখক: ডঃ অনির্বাণ মিত্র (কলকাতার ইনস্টিটিউট অব জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বায়োটেকনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক)

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#covid 19 vaccine, #corona vaccine

আরো দেখুন