‘জন-গণ-মন’ নিয়ে বিতর্কের সূত্রপাত ১৯১১ সালেই
‘জন-গণ-মন’ – ভারতের জাতীয় সঙ্গীত। এই গান ভারতের ১৩০ কোটি জনতার কথা বলে। অথচ সেই গান লিখেই বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠে ছিল, ইংরেজদের আনুগত্য প্রদর্শনে ওই গান লেখা হয়েছিল৷
বিতর্কের কারণ হল গানটি নাকি লেখা হয়েছিল ১৯১১ সালের ডিসেম্বর মাসে রাজা পঞ্চম জর্জের দিল্লি দরবারের কিছুদিন আগে। যদিও এই গানটি প্রথম গাওয়া হয়েছিল সেই বছরের ২৭ ডিসেম্বর আজকের দিনে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনের দ্বিতীয় দিনে। সেদিনের অ্যাজেন্ডা ছিল রাজা পঞ্চম জর্জকে একটু আনুগত্যমূলক স্বাগত জানানোর প্রস্তাবনা।
রাজার সম্মানে সেদিন হিন্দিতে রামভূজ চৌধুরীর একটি গান গাওয়া হয়। আবার কাকতালীয়ভাবে সেই দিনই রবীন্দ্রনাথ রচিত এই গানটিও অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত রবীন্দ্রবিরোধী এবং ইংরেজপন্থী সাংবাদিকদের ইচ্ছাকৃত ভুলে একটি ভ্রান্ত খবর প্রচারিত হয়েছিল ৷ যাতে বলা হয়েছিল- রবীন্দ্রনাথের জন গণ মন গানটিও সম্রাটের প্রতি সম্মানার্থে রচিত হয়েছে।
পরদিনের ইংরেজি সংবাদপত্রগুলিতে এমন সংবাদ প্রচারিতও হয়, যে “বাঙালি বাবু তথা কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশেষত সম্রাটকে স্বাগত জানিয়ে একটি গান রচনা করেছেন।” স্বাভাবিকভাবেই রবীন্দ্রবিরোধীরা এই গানটি আসলে সম্রাটের বন্দনাগান বলে প্রচারে নামেন।
প্রকৃত ঘটনা অবশ্য জানা যায় বহু পরে। ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের ২০ নভেম্বর বিশ্বভারতীর প্রাক্তনী পুলিনবিহারী সেনকে লেখা রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি থেকে।
কবি লিখেছেন, ‘সে বৎসর ভারত সম্রাটের আগমনের আয়োজন চলছিল। রাজসরকারে প্রতিষ্ঠাবান আমার কোনও বন্ধু সম্রাটের জয়গান রচনার জন্যে আমাকে বিশেষ করে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। শুনে বিস্মিত হয়েছিলুম, সেই বিস্ময়ের সঙ্গে মনে উত্তাপেরও সঞ্চার হয়েছিল। তারই প্রবল প্রতিক্রিয়ার ধাক্কায় আমি জন-গণ-মন অধিনায়ক গানে সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয় ঘোষণা করেছি, পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থায় যুগ যুগ ধাবিত যাত্রীদের যিনি চিরসারথি, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক, সেই যুগযুগান্তরের মানবভাগ্যরথচালক যে পঞ্চম বা ষষ্ঠ কোনো জর্জই কোনক্রমেই হতে পারেন না সে কথা রাজভক্ত বন্ধুও অনুভব করেছিলেন।’
ভারতের স্বাধীনতার প্রাক্কালে কোনও জাতীয় সংগীত নির্বাচিত হয়নি। ১৯৪৭ সংগীত স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে জাতিসংঘে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের কাছে কোনো এক অনুষ্ঠানে বাজানোর জন্য ভারতের জাতীয় সংগীতের একটি রেকর্ড চাওয়া হলে, তারা তৎক্ষণাৎ ভারত সরকারকে বিষয়টি অবহিত করেন ও জনগণমন বাজানোর পক্ষে মত প্রকাশ করেন। সরকারের অনুমোদনক্রমে জাতিসংঘের অর্কেস্ট্রাবাদনের একটি গ্রামোফোন রেকর্ড সেই অনুষ্ঠানে সাফল্যের সঙ্গে বাজানো হয়।
জওহরলাল নেহরু পরে বলেছিলেন, এই গানের সুর সেদিন সবার দ্বারা প্রশংসিত হয় এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা এই সুরটির স্বাতন্ত্র্য ও আভিজাত্যে মুগ্ধ হয়ে এর স্বরলিপি চেয়ে পাঠান। দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর এর স্বরলিপিকার।
ভারতের জাতীয় সংগীতের ‘সিন্ধু’ শব্দটিকে পরিবর্তিত করে ‘কাশ্মীর’ শব্দটি যোজনা করার দাবি উঠেছিল ২০০৫ সালে। যাঁরা দাবি তুলেছিলেন, তাদের যুক্তি ছিল, ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ভারত বিভাগের পর সিন্ধু প্রদেশ সম্পূর্ণত পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এই দাবির বিরোধীরা পাল্টা যুক্তি দেন, জাতীয় সংগীতে ‘সিন্ধু’ শব্দটি কেবলমাত্র সিন্ধু প্রদেশ নয়, বরং সিন্ধু নদ ও ভারতীয় সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ সিন্ধি ভাষা ও সংস্কৃতিরও পরিচায়ক। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই যুক্তি মেনে জাতীয় সংগীতের ভাষায় কোনোরূপ পরিবর্তনের বিপক্ষে মত দেন। আবারও জাতীয় সংগীত বদলে ফেলার দাবি জানিয়ে বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন বিজেপি সাংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে কেরল রাজ্যের জিহোবাস উইটনেস-এর কয়েকজন ছাত্র বিদ্যালয়ে জাতীয় সংগীত গাইতে অস্বীকার করলে, তাদের স্কুল থেকে বিতাড়িত করা হয়। একজন অভিভাবক সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হলে, সুপ্রিম কোর্ট কেরল হাইকোর্টের রায় বদলে স্কুল কর্তৃপক্ষকে ছাত্রদের পুনরায় ভরতি নেওয়ার নির্দেশ দেন।
সুপ্রিম কোর্টের সেই ঐতিহাসিক রায়ে বলা হয়েছিল, ‘আমাদের (ভারতীয়) ঐতিহ্য শেখায় সহিষ্ণুতা, আমাদের দর্শন শেখায় সহিষ্ণুতা, আমাদের সংবিধান শেখায় সহিষ্ণুতা, তাকে আমরা যেন নষ্ট করে না ফেলি।’