ব্যাঙ্ক সংযুক্তির জেরে পরিষেবা লাটে
২৬ ডিসেম্বর বিদ্যুৎ বিল মেটানোর শেষদিন ছিল বাগুইআটির গোপাল নস্করের। যাতে তারিখ মনে রাখার ভুলে পেনাল্টি দিতে না-হয়, সেজন্য বিদ্যুৎ সংস্থাকে গোপালবাবু আগাম জানিয়ে রেখেছিলেন, তাঁর সেভিংস অ্যাকাউন্ট থেকে যেন নিয়মিত টাকা কেটে নেওয়া হয়। কিন্তু ওইদিন বিদ্যুৎ সংস্থা তাঁকে জানায়, তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা কাটা যায়নি। বিলও পেমেন্ট হয়নি। কেন? বিদ্যুৎ সংস্থা জানিয়েছে, যে ব্যাঙ্কে তাঁর অ্যাকাউন্ট, তার কোড বদলে গিয়েছে। নতুন কোড বিদ্যুৎ সংস্থার সিস্টেমে গ্রাহ্য হচ্ছে না। আসলে গোপালবাবু যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের গ্রাহক, সেটি মিশে গিয়েছে অন্য একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের সঙ্গে। এরপর বহু কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে বিল মেটান গোপালবাবু। কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পেরনোয় তিনি প্রাপ্য ছাড় পাননি। এই জটিলতায় তিনি পেনাল্টির মুখেও পড়তে পারতেন। ঋণ মেটানোর ইএমআই থাকলেও তাঁকে একই সমস্যায় পড়তে হতো। সেক্ষেত্রে তাঁর ক্রেডিট রেটিংও খারাপ হতো।
যেখানে ব্যাঙ্ক সংযুক্তির (Bank Affiliation) কারণে বিদ্যুৎ বিল মেটাতে এই সমস্যায় পড়েছেন গোপালবাবু, সেখানে আরও একটি আশঙ্কা মাথায় আসে তাঁর—বাবার পেনশন। কারণ বাবার অ্যাকাউন্টও ওই ব্যাঙ্কে। পেনশন নিয়েও সমস্যার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না ব্যাঙ্ক কর্মীরা। তাই আগেভাগেই নির্দিষ্ট করণীয় কাজগুলি সেরে ফেলেন গোপালবাবু।
ব্যাঙ্ক সংযুক্তি (মার্জার) নিয়ে গোপালবাবুর অভিজ্ঞতার শুরু অবশ্য এখানেই নয়। সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক লকারের বার্ষিক চার্জ এবারও যথানিয়মে নির্দিষ্ট সময়ে কেটে নিয়েছিল। তারপরেও গত নভেম্বরে একটি এসএমএস পাঠিয়ে তাঁকে ফের লকার চার্জ মেটাতে বলা হয়! জবাব জানতে তিনি ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখেন, তাঁর মতো জনা পঞ্চাশ গ্রাহক একই সমস্যা নিয়ে এসেছেন। অবশেষে তাঁদের জানানো হয়, মার্জারের জন্যই এই ঝঞ্ঝাট এবং এসএমএস-টি অগ্রাহ্য করতে হবে।
গোপাল নস্কর কোনও ব্যতিক্রমী ব্যাঙ্ক গ্রাহক নন। গত এপ্রিলে দশটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক জুড়ে চারটি ব্যাঙ্কে পরিণত হয়। প্রশাসনিক জটিলতা কাটিয়ে এখন ব্যাঙ্কগুলির আর্থিক দিকগুলির সংযুক্তিকরণের কাজ চলছে। তাতেই গ্রাহকদের দুর্ভোগ বেড়েছে। গ্রাহকদের অভিযোগ, দু’টি ব্যাঙ্ক যখন অপর একটি ব্যাঙ্কের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে গিয়েছে, তখন তাঁদের বর্তমান ব্যাঙ্কটির নিয়ম অনুযায়ী অ্যাকাউন্টে ন্যূনতম ব্যালান্স রাখতে বাধ্য করা হচ্ছে। অথচ ব্যাঙ্ক এনিয়ে কিছুই জানায়নি। আগে যেখানে তাঁরা সেভিংস অ্যাকাউন্টের ব্যালান্স শূন্য রাখতে পারতেন, সেখানে এখন তাঁরা দু’হাজার টাকা রাখতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যথায় পেনাল্টি। এমনকী সংযুক্তিকরণের জন্য সার্ভিস চার্জও বেড়ে গিয়েছে কিছু ক্ষেত্রে। ব্যাঙ্ক পরিষেবা পেতে যে কোডগুলি দরকার, তার মধ্যে অন্যতম আইএফএসসি এবং এমআইসিআর। এছাড়াও আছে গ্রাহকের নিজস্ব কাস্টমার আইডি। ব্যাঙ্ক সংযুক্তির ফলে এই সবেরই পরিবর্তন হচ্ছে। এর ফলে অনলাইনে টাকা পাঠানো বা ‘পোস্ট ডেটেড’ চেক দিতে সমস্যায় পড়ছেন গ্রাহকরা। তাঁদের অনেকেই বলছেন, বিষয়গুলি সম্পর্কে বিশদে কোনও তথ্য ব্যাঙ্ক দিচ্ছে না।
লকডাউনের (LockDown) সময় থেকেই পাশবই ‘আপডেট’ করা মারাত্মক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বহু গ্রাহক মাসের পর মাস পাশবই আপডেট করাতে পারেননি। ব্যাঙ্ক সংযুক্তি তার অন্যতম কারণ বলেই জানাচ্ছেন ব্যাঙ্ককর্তারা। যাঁরা মোবাইল অ্যাপ থেকে ই-পাশবুক দেখতে চাইছেন, তাঁদের অ্যাপ যান্ত্রিক ত্রুটির কথা জানাচ্ছে। ফলে তা দেখা যাচ্ছে না। এমনকী, যাঁরা ঋণ নিয়েছেন, তাঁরাও জানতে পারছেন না ঋণ সংক্রান্ত তথ্য। বিষয়গুলি যে সাধারণ গ্রাহকদের সমস্যায় ফেলছে, তা মেনে নিয়েছেন অল ইন্ডিয়া ব্যাঙ্ক এমপ্লয়িজ অ্যাসোসিয়েশনের সর্বভারতীয় সভাপতি রাজেন নাগর। তিনি বলেন, উপযুক্ত পরিকাঠামো ছাড়াই এই সংযুক্তিকরণের দায় নিতে হচ্ছে গ্রাহকদের। ন্যূনতম ব্যালান্স না-থাকায় বহু গ্রাহক পেনাল্টি গুনছেন। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ করছি। আমাদের দাবি, ন্যূনতম ব্যালান্স তুলে দেওয়া হোক। সার্ভিস চার্জ কেন গ্রাহককে মেটাতে হবে? প্রশ্ন আমাদেরও। গ্রাহক স্বার্থে নয়, শুধু নিজেদের স্বার্থে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন করেছে ব্যাঙ্ক। তার আর্থিক দায় গ্রাহকরা নেবেন কেন?