হচ্ছে টা কী? বিভাগে ফিরে যান

‘পুরোনো রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে দূরে সরিয়ে রাখা উচিৎ রাজ্যপালের’ – বিস্ফোরক গোপালকৃষ্ণ গান্ধী

January 10, 2021 | 4 min read

পশ্চিমবঙ্গ থেকে পুদুচেরি, দিল্লি থেকে কেরল – রাজ্য সরকারের সাথে রাজ্যপালের সংঘাত প্রতিনিয়তই সংবাদ শিরোনামে থাকে। কোনও কোনও রাজ্যপালকে দেখা যায় রাজনৈতিক দলের হয়ে সওয়াল করতে, কেউ কেউ বা সামাজিক মাধ্যমে হামেশাই বিতর্কিত মন্তব্য করেন। 

গণতন্ত্রে রাজ্যপালের ভূমিকা কী, তাদের আচরণই বা কেমন হওয়া উচিৎ – এইরকম নানা প্রশ্ন নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি কথা বলল পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীর (Gopal Krishna Gandhi) সঙ্গে। রইল সেই সাক্ষাৎকার। 

প্রশ্ন: প্রাক্তন রাজ্যপাল হিসেবে আপনার কাছে প্রশ্ন – গণতন্ত্রে একজন রাজ্যপালের ভূমিকা ঠিক কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

গোপালকৃষ্ণ গান্ধী: একজন রাজ্যপাল অনেক ভূমিকা পালন করেন। একধারে তিনি সংবিধান ও রাজ্যের আইনের ধারক ও বাহক। এছাড়াও তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা বিরোধীপক্ষের পরামর্শদাতা। তিনি নিঃশর্তভাবে রাজ্যের মানুষের অভিভাবকত্ব করেন। রাজ্যপাল হল সেই ব্যক্তি যাঁকে সরকারী কর্মীরা এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলি পরামর্শদাতা হিসাবে দেখে থাকে।  

রাজ্যপালের কাজ সম্বন্ধে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আর ভেঙ্কটরমণের ( Ramaswamy Venkataraman) একটি অসাধারণ উক্তি আছে। তিনি বলেছিলেন, রাজ্যপাল একজন ‘এমার্জেন্সি লাইট’। যখন আসল ‘পাওয়ার লাইন’ বন্ধ হয়ে যায়, তখন আলোর প্রয়োজন মেটায় এমার্জেন্সি লাইট, যতক্ষণ না আসল ‘পাওয়ার লাইন’ ফিরে আসছে। তার মানে, যখন কোনও বিচ্ছেদ ঘটে, সাধারণ ভাবে বলতে গেলে, যখন একটি নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হয় এবং একটি নতুন সরকার তৈরী হতে চলেছে, তখন, কিংবা বিশেষ পরিস্থিতিতে যখন মেয়াদ থাকাকালীন একটি  সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায় এবং অপর কোনো নেতাকে সরকার চালানোর জন্য খুঁজে বের করতে হবে যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে পারবেন, তখন রাজ্যের প্রধানকে কিছু সময়ের জন্য ‘এমার্জেন্সি লাইট’ হয়ে আলো দিতে হবে, যতক্ষণ না স্বাভাবিকত্ব ফিরেছে। কিছু চরম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির শাসন ও জারি করতে হয়।   

বিচারকদের মতোই, রাজ্যপালকে পুরোনো রাজনৈতিক চিন্তাধারাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে এই সাংবিধানিক দায়িত্ব নিতে হয়।  ১৯৪৭ এর পর বলতে গেলে প্রায় সব রাজ্যপালই তাদের কর্তব্য করে এসেছেন, নিজেদের রাজনৈতিক মতবাদের ঊর্ধ্বে উঠে। আমি ২টি উদাহরণ দিতে চাই।  

কর্ণাটকের রাজ্যপাল টি যেন চতুর্বেদী এনডিএ দ্বারা নিযুক্ত হন। কিন্তু তাঁর কাজে কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাত খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার মেয়াদটি পুরোপুরি সাংবিধানিক সুতোয় বাঁধা ছিল।  রাজ্যপাল রাম কাপসে সঙ্ঘ পরিবারের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি যখন লেফট্যানেন্ট গভর্নর, তখন আন্দামানে সুনামী হয়। তখন তিনি টারবাইন ইঞ্জিনের মতো মোকাবিলা করেন। একনিষ্ঠ, শান্ত এবং শক্তভাবে।  তার কাজে কোনো রাজনীতি ছিল না। সাংবিধানিক ও কর্তব্যপরায়ণভাবে কাজ করেছেন তিনি।

এখানে মহাত্মা গান্ধী (Mahatma Gandhi) সম্পর্কে উল্লেখ করা যেতে পারে। 

১৯৪৭-এর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে, শ্রী নারায়ণ আগরওয়াল, গান্ধীবাদী এবং পরে আচার্য বিনোবা ভাবের শিষ্য, একটি লেখা লিখেছিলেন, ” আমার মতে রাজ্যপালের কোনো প্রয়োজন নেই, মুখ্যমন্ত্রী এই কাজ করতে পারেন, এতে প্রতিমাসে ৫,৫০০ টাকা, যা রাজ্যপালকে দেওয়া হয়, বাঁচবে…”। এর উত্তরে হরিজন পত্রিকায় গান্ধীজী লেখেন, ” …যদিও আমি জনগণের তহবিলের প্রতিটি পাই-পয়সা বাঁচানোর পক্ষপাতী, তবুও রাজ্যপালকে সরিয়ে দেওয়া এবং মুখ্যমন্ত্রীকে সমান মনে করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আমি মনে করি রাজ্যপালকে বেশি ক্ষমতা দেওয়া উচিত নয়, কিন্তু তাকে অলংকার হিসেবে বসিয়ে রাখাও ঠিক নয়।  তাদের সেই ক্ষমতা থাকা উচিত যাতে তাঁরা মন্ত্রিসভার নীতির ওপর প্রভাব ফেলতে পারেন।  তাদের নিরপেক্ষ জায়গা থেকে তাঁরা  ঠিকমত দৃষ্টিভঙ্গি নিতে পারেন এবং মন্ত্রিসভার ভুল সংশোধন করতে পারেন। তাদের সীমিত পরিসরে বিস্তৃত নৈতিক প্রভাব ফেলার অবকাশ থাকতে হবে।

সিঙ্গুর সমস্যার সমাধানে সরকার ও বিরোধীপক্ষের মধ্যস্থতা করেছিলেন গোপালকৃষ্ণ গান্ধী, সংগৃহীত চিত্র

প্রশ্ন: আপনি যে সময়ে বাংলার রাজ্যপালের দায়িত্ব সামলেছেন, সে এক অশান্ত সময় ছিল রাজ্য রাজনীতিতে। সেই অভিজ্ঞতার কথা যদি একটু দর্শকদের সঙ্গে ভাগ করে নেন ….

গোপালকৃষ্ণ গান্ধী: পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাসে খুব কম সময়ই এমন আছে যখন কিছু না কিছু গুরুতর বা হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটেনি।  ২০০৪-২০০৯ এই বছরগুলি সেই  অর্থে আমার অভিজ্ঞতা আমার পূর্বসূরির থেকে অন্যরকম কিছু ছিল না। ওই সময়টা আমি মনে রাখবো অশান্তির জন্য নয় বরং তখন আমি কিছু অসাধারণ মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলাম। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং বিরোধীনেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) দায়িত্বশীলতা এবং পরিমিতিবোধের ফলে সিঙ্গুর সমস্যার সমাধানে কিছুটা হলেও দিশা পাওয়া গেছিল। এটা ছিল দায়িত্বশীল গণতন্ত্রের নিদর্শন – রাজ্যের পরিণত মনোভাবের প্রতি শ্রদ্ধা।

প্রশ্ন: প্রাক্তন রাজ্যপাল হিসেবে আপনার কী মনে হয় যে, বর্তমানে রাজ্যপাল পদটি অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে?

গোপালকৃষ্ণ গান্ধী: একদমই নয়। বরং, আমার মনে হয় যে আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে তাদের প্রাসঙ্গিকতা আরও বেড়ে গেছে। কারণ, রাজ্যে রাজ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব আরও প্রকট হয়ে গেছে, যার ফলে একটি বিকল্প বাছাটাও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমতাবস্থায়, সংবিধান মেনে কাজ করাটা গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্যই সম্পূর্ণ সতর্কতা, নৈর্ব্যক্তিকতা এবং রাজ্যের সংস্কৃতির প্রতি সংবেদনশীলতার সঙ্গে। রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান, যথা রাজ্যপালের, সেটাই দায়িত্ব এবং কর্তব্য। 

প্রশ্ন: দেশের স্বাধীনতার পঁচাত্তরতম বছর আসন্ন, সঙ্গে নেতাজীর ১২৫ তম জন্মদিনও। আপনি নিজে গান্ধীজির প্রপৌত্র। বর্তমানে ভারতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা কতটা আছে বলে মনে হয়?

গোপালকৃষ্ণ গান্ধী: আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম যে ভিত্তিতে লড়া হয়েছিল সেটি হল, ভারত দেশটি কোনও এক ধর্মের মানুষের নয়, এক ভাষার মানুষের জন্য নয়, এক মতাদর্শের মানুষের নয়। ভারতবর্ষ সকলের। পাকিস্তান গঠনের পেছনে যে বিভাজক নীতি ছিল, তা আমরা বর্জন করেছি। 

গান্ধীজী এমনই এক সংঘবদ্ধ ভারতের জন্য বেঁচে ছিলেন এবং প্রাণ দিয়েছিলেন। নেতাজির আজাদ হিন্দ ফৌজ, এবং প্রকৃতপক্ষে তাঁর রাজনৈতিক তথা কর্মজীবন হিন্দু-মুসলামন ঐক্যের আদর্শর ওপরই ভিত্তি করে ছিল। তাঁর স্লোগান, তাঁর গান এবং তাঁর বক্তব্য, সবেতেই একটি কথাই উঠে এসেছিল, যে ভারতের বিভিন্নতার প্রতি শ্রদ্ধা ছাড়া দেশ স্বাধীন হতে পারে না। স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকীর দিকে অগ্রসর হতে হতে আমাদের সেই আদর্শর প্রতি পুনরায় নিমজ্জিত করতে হবে।

মহাত্মা গান্ধীর প্রপৌত্র , সংগৃহীত চিত্র

প্রশ্ন: জাতীয়বাদ সম্পর্কে আপনার কী মতামত?

গোপালকৃষ্ণ গান্ধী: ভারতবর্ষকে রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) থেকে বেশি কেউ ভালোবাসেনি। তবে, মূর্ত রূপে নয়, বরং ভারতবর্ষ কী হতে পারে সেই রূপে। নিজের দেশের প্রতি গর্ব নিজের মায়ের প্রতি বিশ্বাসের সমান। তা শুধু দেশের কায়িক রূপকে ভালোবাসা না। নিজের অন্তরের শেকড়কে অনুভব করা। 

যে দেশকে আমি ভালোবাসি, যে দেশকে আমি আপন মনে করি, তা দারা শুকোর সেই দেশ, যা তিনি মুঘল সাম্রাজ্য ছাপিয়ে কল্পনা করেছিলেন। এই দেশের জন্য মাতঙ্গিনী হাজরা, ভগৎ সিংহ, মহাত্মা গান্ধী প্রাণ দিয়েছিলেন। এ সেই দেশ যা বর্ণিত আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পংক্তিতে: ঘোর তিমির ঘন নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্ছিত দেশে… দুঃস্বপ্নে আতঙ্কে। এই রূপ থেকে পরিত্রান চেয়ে তিনি ভারত মায়ের কাছে প্রার্থনা করেছেন। 

এটা সেই ভারত যা তিনি এই গানের শেষ লাইনে ব্যক্ত করেছেন: রাত্রি প্রভাতিল, উদিল রবিচ্ছবি পূর্ব-উদয়গিরিভালে…

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Exclusive Interview, #Gopal Krishna Gandhi

আরো দেখুন