লক্ষ্য নির্বাচন, বাঙালির আবেগ নিয়ে খেলার চেষ্টা মোদীর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আত্মনির্ভরতা’ চেয়েছিলেন: ঠিক যেমন ‘আত্মনির্ভর ভারত’ তিনি নিজে চাইছেন, এবং কাজে পরিণত করছেন, তেমনই। গত ২৪ ডিসেম্বর বিশ্বভারতীর শতবর্ষ সূচনা অনুষ্ঠানে ভিডিয়ো-বার্তায় এ কথা বললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এই প্রথম বার নয়। এর আগে বেশ কয়েক বার মোদী-ভারতের ‘আত্মনির্ভর’ নীতি বর্ণনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কথা তুলেছেন তিনি। তবে এই বারের কথা আলাদা। ২০২১ সালে বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ পূর্ণ হবে, ২০২০ সালের ডিসেম্বরে শততম বর্ষে পা রাখার উদ্যাপন হচ্ছে, সামনেই পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন— এমন একটা মহামুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী আবারও রবীন্দ্রনাথের কথা যে ভাবে তুললেন, তাতে এ বারটা একটু বেশিই বিশেষ। আর তাই এই প্রসঙ্গে বলতে হয় কিছু।
বলতে হয়— না, আমাদের প্রধানমন্ত্রী কথাটা একেবারেই ঠিক বলছেন না। রবীন্দ্রনাথের ‘আত্মশক্তি’র সঙ্গে নরেন্দ্র মোদীর ‘আত্মনির্ভরতা নীতি’র পার্থক্য বিরাট। তাতে এমনিতে কিছু এসে-যায় না। দুই-দুই বার ক্ষমতাশীর্ষে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নিজের নীতি প্রণয়ন করবেন, প্রচার করবেন, এটাই স্বাভাবিক। তাঁর নীতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের (Rabindranath Tagore) কথার মিল থাকতে হবেই বা কেন। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কথা ভুল ভাবে পেশ করার অধিকারও তাঁর নেই। ঠিক যেমন, তাঁদের মনোভূমির অসহিষ্ণু হিন্দুত্বের সঙ্গে স্বামী বিবেকানন্দের মানবতার হিন্দুধর্মকে মিশিয়ে দেওয়ার অধিকারও তাঁদের নেই।
ব্যাপারটা আরওই আপত্তিকর এই জন্য যে, ইদানীং এটা একটা অসুস্থ অভ্যাস হয়ে উঠেছে। বাংলার ভোটের দিকে তাকিয়ে যে কোনও পরিস্থিতিতে যে কোনও প্রসঙ্গে কোনও না কোনও বাঙালি চিন্তাবিদ (না কি এঁরাও এখন বুদ্ধিজীবী?), ধর্মনেতা, রাজনৈতিক নেতাকে জড়িয়ে যা-ইচ্ছে-তাই দাবি করার ঝড় উঠেছে। এর আগেও রাজনীতিতে নেতা বা তারকাদের নাম এসে পড়ত, সন্দেহ নেই। এ রকম প্রণিপাত অন্য নেতানেত্রীরাও করতেন, আমরা হাসতাম। কিন্তু সেই অন্য নেতারা এমন ভাবে রাজনীতির প্রচারে সরাসরি জড়িয়ে নেননি রামকৃষ্ণ, বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্রদের। ‘তাঁরা যা বলেছেন, আমরাই তা করে দেখাচ্ছি’ জাতীয় দাবি আগে এ ভাবে শোনেনি বাঙালি। তাই এখন আমরা ভয় পাচ্ছি। শুনছি, বিজেপিই নাকি আগ-মার্কা রাবীন্দ্রিক, বিবেকানন্দীয়, নেতাজি-নির্ভর, তাই বিজেপিই গড়বে ‘সোনার বাংলা’। যে ভাবে এঁদের কথা বলা হচ্ছে আজকাল, তাকে তাই আমরা আর ‘উদ্ধৃত করা’ বলতে পারি না, ‘আত্মসাৎ করা’ (অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন) বলতে বাধ্য হই।
বলা বাহুল্য, এই সব আত্মসাৎ-দাবির অধিকাংশই পুরো ভুল, যাকে বলে ‘ফেক নিউজ়’। কিন্তু এ বার প্রশ্ন, ‘রিয়েল নিউজ়’-টা জনগণকে দেবেন কে? উল্টো দিকের রাজনীতিকরা তো চূড়ান্ত নির্বিকার। তাঁরা মাঝে মাঝে একটু হাসাহাসি করেন, কিন্তু গুরুত্ব দিয়ে কথাগুলোকে মানুষের কাছে পরিষ্কার করার পরিশ্রমটা করেন না। ফলে ভুল ও মিথ্যের একটা দুষ্টচক্র পশ্চিমবঙ্গে এখন টর্নেডোর মতো শক্তি সঞ্চয় করছে, কোন মুহূর্তে তা বিপুল গতিতে আছড়ে পড়বে বাংলা ও বাঙালির মানসভূমিতে, সেই অনাকাঙ্ক্ষিত অঘটনের প্রতীক্ষায় আমরা সকলে বসে আছি।
নরেন্দ্র মোদীর (Narendra Modi) ভারতনীতিতে আত্মনির্ভর মানে কী, সেটা জানতে গুগল সার্চ করলেই চলে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য গুগল-সার্চ করতে গেলে হয়তো মোদীরা রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে কী বলছেন, সেটাই আবার নতুন করে ফুটে ওঠে— এই হল আজকালকার ফেক নিউজ় বা ভেক প্রচারের দস্তুর। ফলে এখানেই এই বেলা সংক্ষেপে দু’-এক কথা বলে দেওয়া ভাল।
রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন দীর্ঘ দিন। এই দীর্ঘ সময়কাল জুড়েই ‘আত্মশক্তি’র কথা বলেছেন তিনি। হয়তো দুটো কারণ ছিল এর। প্রথমত, পরাধীন দেশের জাতীয় নির্মাণ ও প্রতিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের নিজস্ব শক্তির কথা বলা দরকার ছিল। দ্বিতীয়ত, এই ‘নিজস্ব’ শক্তির বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে কতকগুলো ফাঁদে পড়ার সম্ভাবনা ছিল। হিন্দুসমাজের ফাঁদ। এবং রাষ্ট্রনির্ভর জাতীয়তাবাদের ফাঁদ। এর দুটোতেই খুব বড় বিপদের সম্ভাবনা দেখতেন রবীন্দ্রনাথ। তাই এই ফাঁদগুলো থেকে বেরোতে বার বার জোর দিয়ে বলতেন, ভারতবর্ষীয় ‘সমাজ’-এর কথা। রাষ্ট্র নয়, সমাজ। হিন্দুসমাজ নয়, গোটা সমাজ। এর আত্মশক্তি জাগাতে হবে, হবেই, কেননা ‘সমাজ’-এর শক্তিই ভারতবর্ষের প্রকৃত শক্তি, যা বিভিন্ন সঙ্কটের মধ্যেও দেশের মূল জীবনটাকে ধরে রেখেছে, তাকে নিজের মতো করে চালিত করেছে, সমৃদ্ধ করেছে। তাই রবীন্দ্রনাথের আত্মশক্তি-র মানে বাইরে থেকে মুখ ফিরিয়ে দেশের দরজাটা বন্ধ করে বসে থাকা নয়, দরজা খোলা রেখে সমাজের নিজস্ব ক্ষমতাকে যত্ন করে গড়ে তোলা।
রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক জীবনে নানা পর্ব। প্রথম পর্ব ১৮৯০ থেকে স্বদেশি আন্দোলনের সময় পর্যন্ত, তিনি এই সব কথা বলতে গিয়ে দেশীয় সমাজকে একাধিক বার হিন্দুসমাজ বলে উল্লেখ করেছেন। এর পর, শিলাইদহের জমিদারি দেখাশোনার সূত্রে গ্রামবাংলার অভিজ্ঞতা, এবং স্বদেশী আন্দোলনে হিন্দু-মুসলমান অনৈক্যের অভিজ্ঞতা তাঁকে সতর্ক করে দেয় এই শব্দপ্রয়োগ সম্পর্কে। হিন্দুসমাজ উন্নত, জাগ্রত হয়ে উঠে বৃহৎ হবে, সকলের সঙ্গে মিলেমিশে ভারতের সমাজ তৈরি করবে— এই ভাবনা তাঁর আগেও ছিল, পরেও ছিল। কিন্তু হিন্দুসমাজ বলতে যা বোঝায়, তার মধ্যেকার সঙ্কীর্ণতা ও আত্মকেন্দ্রিক স্পর্ধার বিষয়টা অভিজ্ঞতায় এল ক্রমে ক্রমে। ফলে পরবর্তী কালের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠল যে, সমাজের ভিতরের সামাজিক বিরোধগুলো কাটানোর পথ চাই। এবং সেই পথ হল— আত্মশক্তি, আত্মশিক্ষা, দেশের জন্য সকলে মিলে হাত মিলিয়ে কাজ, যার নাম দিলেন তিনি ‘সমবায়’।
স্বদেশি-পরবর্তী যুগে আরও একটা কথা বুঝলেন তিনি— রাষ্ট্রনির্ভর জাতীয়তাবাদের ফাঁদও কম ভয়ঙ্কর নয়, কেননা তা সমাজকে ভুলিয়ে দেয়, একটা মিথ্যে গরিমা তৈরি করে মানুষের চোখে ঠুলি পরিয়ে দেয়। যতই পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হোক, নিজের দেশের শক্তি জাগানোর পাশাপাশি অন্য দেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামাজিক, মানসিক যোগাযোগের রাস্তাগুলো খুলে রাখতেই হবে, এই কথাটা রবীন্দ্রনাথ দৃঢ় ভাবে বার বার বলতে লাগলেন। কোনও ‘বয়কট’-এ তিনি বিশ্বাস করতেন না, কোনও সঙ্কীর্ণ স্বদেশীয় কর্মপন্থাতেও নয়। এমনকি মহাত্মা গাঁধীর অসহযোগ ও স্বনির্ভরতার ভাবনার প্রতীক চরকাও রবীন্দ্রনাথের কাছে আপত্তিকর হয়ে ওঠে একই কারণে।
সুতরাং স্বদেশি পর্যায়ের আগে ও পরে, রবীন্দ্রনাথের লেখাপত্রের মধ্যে বেশ একটা পরিবর্তন এসেছিল। খেয়াল করলে দেখা যাবে, আজকের নব্য বিজেপি বিশেষজ্ঞরা, যাঁরা মোদী ও অন্যান্য অবাঙালি নেতাদের রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি ‘সাপ্লাই’ দেন, তাঁরা কেবল প্রথম দিককার স্বদেশি যুগের লেখাপত্রের মধ্য থেকেই সন্তর্পণে এটা-ওটা বেছে নেন, ভুলেও তাঁরা কালান্তর প্রবন্ধাবলি, কিংবা গোরা বা ঘরে-বাইরে উপন্যাসের পাতা খুলেও দেখেন না। অথচ সেখানেই কিন্তু এ সব বিষয়ে সবচেয়ে বিশদ আলোচনা আছে। তাঁরা কেবল ‘স্বদেশী সমাজ’, ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ’ ইত্যাদি স্বদেশি-পূর্ব দু’-একটা প্রবন্ধে কোনও রকমে ঘাঁটি তৈরি করেছেন, তাও হিসেব করে কয়েকটা বাক্যের মধ্যে।
অর্থাৎ, এক, ওই সময়কার লেখাপত্রের বাইরে তাঁরা যান না, এবং, দুই, ওই সময়ের লেখার থেকেও ছেঁটেকেটে বিকৃত করে বাক্য তোলেন, প্রসঙ্গ-বিরহিত ভাবে— ‘সিলেকটিভলি’, ‘আউট অব কনটেক্সট’। আমরা অনেকেই দেখেছি, রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক বেশ কিছু হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা গত দু’এক বছরে এ দিক-ও দিক ঘুরছিল। মানুষকে বোঝানো হচ্ছিল, রবীন্দ্রনাথও বিজেপির হিন্দুত্ববাদেই বিশ্বাস করতেন, ভারী মুসলিমবিরোধী ছিলেন!
কোনও উদ্ধৃতি না দিয়েই রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে এত কথা বললাম এই জন্য যে, বাঙালির এ বারের কাজ কিন্তু এই উদ্ধৃতি-পাল্টা উদ্ধৃতি সংস্কৃতির বাইরে বেরিয়ে এসে এই মানুষরা কী বলে গিয়েছেন, সেটা মনে রাখা। আজ যদি রবীন্দ্রনাথকে ইসলামবিরোধী, আরএসএস-বাদী, মোদী-পন্থী হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরও একটা দায়িত্ব থেকে যায় সেই ‘ফেক নিউজ়’ প্রতিহত করার। ‘রিয়েল নিউজ়’ কেউ হাতে তুলে দেবে না সব সময়। নিজেদেরই তা বার করে জেনে নিতে হবে। কষ্ট কী, বাংলাই তো!
সেই জেনে নিতে বসে অবশ্য একটা ভারী গোলমেলে উপলব্ধি হতে পারে। যদিও রবীন্দ্রনাথ আর মহাত্মা গাঁধীর বৌদ্ধিক নৈকট্য ও পারস্পরিক শ্রদ্ধার কথা সুবিদিত— কিন্তু রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বক্তব্যের কাছাকাছি যদি ভারতের কোনও নেতা আসতে পেরে থাকেন, তবে দুই জনের নাম করতে হয়: সুভাষচন্দ্র বসু আর জওহরলাল নেহরু। দুই জনেরই জাতীয়তার বোধে, অন্যান্য ভাবনাচিন্তায় রবীন্দ্রচিন্তার ছাপ ছিল। তাঁরা সচেতন ভাবে সেই ছাপ বহন করতেন। রবীন্দ্রনাথও জানতেন। ১৯৩৬ সালে মহাজাতি সদনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথ ‘দেশনায়ক’ বলেছিলেন সুভাষচন্দ্রকে, তাঁর মনে হয়েছিল ইনি হতে পারবেন দেশের প্রকৃত জাতীয় নেতা। জওহরলালের প্রতিও তাঁর ছিল বিশেষ স্নেহ, জওহর-কন্যা ইন্দিরা পড়াশোনা করতে শান্তিনিকেতনেই এলেন। পরবর্তী কালে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতি থেকে বিদেশ-নীতি, অনেক কিছুতেই রবীন্দ্র-ভাবনার সূত্র লুকিয়ে ছিল।
আর আজ, ভোট-তাড়নায় এই নেতাজি-নেহরুর প্রিয় রবীন্দ্রনাথকে ধরেই টানাটানি? এতই দুরবস্থা?