মাঘোৎসবের পুণ্য তিথিতে এই রবীন্দ্র বাণী উদ্বুদ্ধ করুক সকলকে
রাজা রামমোহন রায় প্রবর্তিত ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীদের বাৎসরিক উৎসব মাঘোৎসব। প্রতি বছর মাঘ মাসের ১১ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় এই উৎসব।
১৮২৮ সালে ২০ আগষ্ট (৬ ভাদ্র) রামমোহনের উদ্যোগে ব্রাহ্ম মতাদর্শের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে, উত্তর কলকাতার বাঙালি খ্রিষ্টান কমল বোসের বাড়িতে একটি ‘ধর্মসভা’র আয়োজন করেন। এই সভার নামকরণ করা হয়েছিল ‘ব্রাহ্মসভা’। এই সভার স্মরণে প্রতিবৎসর আয়োজন করা শুরু হয়েছিল প্রার্থনা ও সঙ্গীতানুষ্ঠান, আর এই আয়োজনের নামকরণ করা হয়েছিল ‘ভাদ্রোৎসব’। ‘ধর্মসভা’র প্রতিষ্ঠার প্রায় দুই বছর পর, ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে জানুয়ারি (১১ই মাঘ), রাজা রামমোহন রায়ের উৎসাহে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে একটি অনুষ্ঠানের ভিতর দিয়ে ব্রাহ্মসমাজের ঘোষণা দেন। পরে এই বিশেষ দিনকে ব্রাহ্ম ধর্মাবলম্বীরা ‘মাঘোৎসব’ হিসেবে পালন করা শুরু করেন।
১৩১৫ বঙ্গাব্দে মাঘোৎসব উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, এই উৎসব মানবসমাজের উৎসব। এ-কথা যদি সম্পূর্ণ প্রত্যয়ের সঙ্গে আজ না বলতে পারি তা হলে চিত্তের সংকোচ দূর হবে না; তা হলে এই উৎসবের ঐশ্বর্যভাণ্ডার আমাদের কাছে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হবে না; আমরা ঠিক জেনে যাব না কিসের যজ্ঞে আমরা আহূত হয়েছি।
তিনি আরও বলেন, যিনি সত্যম্ তাঁর আলোকে এই উৎসবকে সমস্ত পৃথিবীতে আজ প্রসারিত করে দেখব; আমাদের এই প্রাঙ্গণ আজ পৃথিবীর মহাপ্রাঙ্গণ; এর ক্ষুদ্রতা নেই।
একদিন ভারতবর্ষ তাঁর তপোবনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন–
শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রা
আ যে দিব্যধামানি তস্থুঃ,
বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং
আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ।
হে অমৃতের পুত্রগণ যারা দিব্যধামে আছ সকলে শোনো– আমি জ্যোতির্ময় মহান পুরুষকে জেনেছি।
সেই যেদিন ভারতবর্ষের তপোবনে অনন্তের বার্তা এসে পৌঁছেছিল, সেদিন ভারতবর্ষ আপনাকে দিব্যধাম বলে জানতেন, সেদিন তিনি অমৃতের পুত্রদের সভায় অমৃতমন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন; সেদিন তিনি বলেছিলেন–
যস্তু সর্বানি ভূতানি আত্মন্যেবানুপশ্যতি,
সর্বভূতেষু চাত্মানাং ততো ন বিজুগুপ্সতে।
যিনি সর্বভূতকেই পরমাত্মার মধ্যে এবং পরমাত্মাকে সর্বভূতের মধ্যে দেখেন তিনি কাউকেই আর ঘৃণা করেন না।
ভারতবর্ষ বলেছিলেন–
তে সর্বগং সর্বতঃ প্রাপ্য ধীরা যুক্তাত্মানঃ সর্বমেবাবিশন্তি।
যিনি সর্বব্যাপী, তাঁকে সর্বত্রই প্রাপ্ত হয়ে তাঁর সঙ্গে যোগযুক্ত ধীরেরা সকলের মধ্যেই প্রবেশ করেন।
সেদিন ভারতবর্ষ নিখিল লোকের মাঝখানে দাঁড়িয়েছিলেন; জলস্থল-আকাশকে পরিপূর্ণ দেখেছিলেন, ঊর্ধ্বপূর্ণংমধ্যপূর্ণমধঃপূর্ণং দেখেছিলেন। সেদিন সমস্ত অন্ধকার তাঁর কাছে উদ্ঘাটিত হয়ে গিয়েছিল। তিনি বলেছিলেন–বেদাহং। আমি জেনেছি, আমি পেয়েছি।
সেইদিনই ভারতবর্ষের উৎসবের দিন ছিল; কেননা সেইদিনই ভারতবর্ষ তাঁর অমৃতযজ্ঞে সর্বমানবকে অমৃতের পুত্র বলে আহ্বান করেছিলেন– তাঁর ঘৃণা ছিল না, অহংকার ছিল না। তিনি পরমাত্মার যোগে সকলের মধ্যেই প্রবেশ করেছিলেন। সেদিন তাঁর আমন্ত্রণধ্বনি জগতের কোথাও সংকুচিত হয় নি; তাঁর ব্রহ্মমন্ত্র বিশ্বসংগীতের সঙ্গে একতানে মিলিত হয়ে নিত্যকালের মধ্যে প্রতিধ্বনিত হয়েছিল– সেই তাঁর ছিল উৎসবের দিন।