বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

মধুসূদন, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা

January 25, 2021 | 3 min read

বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল আধুনিক কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত। কবিতার বিষয় ও শৈলীতে তিনি বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচনাকারী। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধারণার ভারতীয় সংস্করণ, দেশমাতার প্রতি অমিত ভালোবাসা, মহাকাব্য রচনা, অমিত্রাক্ষর ছন্দ সৃষ্টি ও তার যথার্থ প্রয়োগ, সনেট রচনা, পত্রকাব্য রচনা প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর চিন্তার প্রতিফলন এবং সৃজন-প্রয়াস বাংলা সাহিত্যভাণ্ডারকে দান করেছে অভূতপূর্ব মর্যাদা ও সৌন্দর্য। 

এছাড়া বাংলা সাহিত্যে প্রথম সফল ঐতিহাসিক ও ট্র্যাজেডি নাটক এবং প্রথম মঞ্চসফল নাটক রচনার জন্যও তিনি সবিশেষ পরিচিত। তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য বাংলা সাহিত্যের প্রথম এবং এক অর্থে একমাত্র মহাকাব্যের মর্যাদায় আসীন; বাংলা ভাষায় সনেট সৃষ্টি ও পরিচর্যায় এখনও পর্যন্ত মধুসূদন অবিকল্প ব্যক্তিত্ব! পত্রকাব্য রচনায়ও তিনি দেখিয়েছেন পথপ্রদর্শকের প্রণোদনা।

মধুসূদনের জন্ম বাংলার ইতিহাসের এক যুগসন্ধিক্ষণে। উনিশ শতকের শুরুতে এ ভূখণ্ডে ঘটে নানান পরিবর্তন; বাংলার নবজাগরণের সে এক বিরাট শুভসময়! ইউরোপ-আমেরিকার শিক্ষা-সভ্যতা-সংস্কৃতি-ধর্ম-দর্শন-মানবতা-ইতিহাস প্রভৃতির প্রভাব ভারতবাসীর জীবনে সামগ্রিকভাবে আমূল পরিবর্তনের আবহাওয়া প্রবাহিত করল। আত্মমুক্তির আবাহন আর সংস্কারমুক্তির চিন্তা তখন ভারতকে আন্দোলিত করেছিল।   মধুসূদন সে জলবাতাসে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন; সেসব প্রবণতা আত্মস্থ করেছিলেন বেশ দ্রুত। এছাড়া উনিশশতকি দেশপ্রেম আর স্বাধীনতা স্পৃহাও তাঁকে আকৃষ্ট করেছিল প্রবলভাবে।

ইউরোপের প্রতি মাইকেল মদুসূদন দত্তের প্রবল এবং আপাত অস্বাভাবিক ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়েছে; তিনি যে-কোনো উপায়ে এশিয়া পরিত্যাগ করার জন্য মরিয়া হয়ে  উঠেছিলেন। অনেকে মনে করেন, বিশেষত ইংল্যান্ডপ্রীতির কারণেই কবি মধুসূদন ধর্মান্তরিত হয়ে খ্রিস্টানধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন; বিয়েও করেছিলেন খ্রিস্টান নারীকে। ধর্ম পরিবর্তন করে তিনি নামের আগে মাইকেল শব্দটি যুক্ত করেন। আসলে ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে সারা পৃথিবীর শিল্পভুবনে নিজেকে হাজির করা এবং খ্যাতি অর্জনের নেশা আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল মধুসূদন দত্তকে। 

তিনি গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু, সংস্কৃত, তেলেগু, ফরাসি, জার্মান, ইতালীয় ভাষাও শিখেছিলেন এবং পাশ্চাত্য চিরায়ত সাহিত্য অধ্যয়ন করেছিলেন। মধুসূদনের যখন জন্ম, তখন ভারতে সরকারি কাজকর্মের ভাষা ছিলো ফারসি। ১৮৩৫ খিস্টাব্দ থেকে আদালত এবং সরকারি কাজকর্মের ভাষা হিসেবে চালু হয় ইংরেজি। তখন স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজি শেখার চাহিদা বাড়তে লাগলো! এই সহজ সত্যটি, মধুসূদনের সাহিত্যপাঠের সময়, আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন।

বাংলাকে উপেক্ষা করে সে সময় তিনি ইংরেজিতে সাহিত্যচর্চার যে প্রয়াস চালিয়েছিলেন, তা যে পরবর্তীকালে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে- সে কথা তিনি এবং তাঁর পাঠক আজ ভালোভাবেই অবগত! ইংল্যান্ড যাবার পথে তাঁর স্বপ্নের দেশের কাছাকাছি পৌঁছে যাবার আবেগময় অনুভূতির কথা আমরা জানতে পারি বন্ধু গৌরদাসকে লেখা চিঠি থেকে। 

কবি লিখছেন: “হে আমার প্রিয় ও পুরনো বন্ধু। আমি সীলোন নামক একটা জাহাজে চলেছি। এখন তোমাকে কয়েক ছত্র লিখব বুঝলে বৎস!… এ মুহূর্তে আমি ভেসে যাচ্ছি বিখ্যাত সেই ভূমধ্যসাগরের মাঝ দিয়ে, এখান থেকে উত্তর আফ্রিকার পর্বতাকীর্ণ উপকূল দেখা যায়। গতকাল ছিলাম মলটায়, গত রোববারে আলেকজান্দ্রিয়ায়। আর মাত্র কয়েকদিনের ভেতরেই ইংল্যান্ডে পৌঁছে যাব আশা করি। আজ থেকে বাইশ দিন আগে আমি কলকাতায় ছিলাম। বেশ দ্রুতগতিতেই আমরা চলেছি কী বল? কিন্তু এ ভ্রমণের একটা দুঃখজনক বিষয়ও রয়েছে। সব জানতে পারবে, ধৈর্য ধারণ কর ধৈর্য, বন্ধু। ”

মধুসূদন বাংলায় সনেট লেখার আগে ইংরেজিতে আঠারোটি সনেট রচনা করেছেন। তিনি অবশ্য ভার্সাই থেকে গৌরদাসকে লেখা এক চিঠিতে সনেট রচনায় পেত্রার্ককে অনুসরণ করবেন বলে জানিয়েছিলেন। ১৮৬৫ সালে লেখা একটি চিঠির কিছু অংশ তুলে ধরছি :

 ‌‌‌‌I have been lately reading petrarca- the Italian poet, and scribbling some sennets after his manner. There is one addressed to this very river [কপোতাক্ষ নদ]… I hope to come out what you all think of this new style of poetry.  

১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে কবি মধুসূদন বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে একটি চিঠিতে জানিয়েছিলেন যে, তিনি বাংলা ভাষায় সনেট রচনা আরম্ভ করেছেন এবং কবি-মাতৃভাষা নামে একটি সনেট লেখার কাজ সমাপ্ত করেছেন। পরবর্তীকালে ওই সনেটটি বঙ্গভাষা নামে তাঁর “চতুর্দশপদী কবিতাবলী” গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়। বঙ্গভাষা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সনেট। কবিতাটির বিষয়ভাবনা এবং পরিবেশনশৈলী মার্জিত-পরিশীলিত ও সংহত। ভুলের জন্য মনোবেদনা এবং ধারাপরিবর্তন করে সিদ্ধি অর্জনের পরিতৃপ্তি কবিতাটির মূল কথা! 

চতুর্দশপদী কবিতা লিখতে গিয়ে মধুসূদন ইতালির কবি জগৎখ্যাত সনেট-রচয়িতা পেত্রার্ক এবং ইংরেজ কবি মিল্টনের কলাকৃতি বিশেষভাবে অনুসরণ করেছেন। বঙ্গভাষা কবিতার শুরুতে লেখকের মানসিক বেদনাবোধ আর আত্ম-উপলব্ধির বিবরণ সাজানো হয়েছে এভাবে:

হে বঙ্গ, ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন;-

তা সবে, (অবোধ আমি!) অবহেলা করি,

পর-ধন-লোভে মত্ত, করিণু ভ্রমণ

পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।

কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি!

অনিদ্রায়, অনাহারে সঁপি কায়, মনঃ,

মজিনু বিফল তপে অবরণ্যে বরি;-

কেলিনু শৈবালে, ভুলি কমল-কানন! [বঙ্গভাষা]

কবি বঙ্গ বলতে বাংলা ভাষাকে বুঝিয়েছেন; তিনি বুঝতে পেরেছিলেন বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্য-ভাণ্ডার অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় এবং উৎকর্ষমণ্ডিত। 

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Madhusudan Datta

আরো দেখুন