‘জয় শ্রীরাম’ বলেন আর পেটান, রামচন্দ্র বা সুভাষচন্দ্র কাউকেই ওঁরা জানেন না- ব্রাত্য বসু
শনিবার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে যে কাণ্ড ঘটেছে, সেটা আমাকে পরশুরামের ‘হনুমানের স্বপ্ন’ গল্পে বানর দলের ‘ঊপ-ঊপ’ ধ্বনি মনে করিয়ে দিয়েছে। প্রথম কথা তাঁরা একটি সরকারি অনুষ্ঠানের সঙ্গে রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠান গুলিয়ে ফেলেছেন। দ্বিতীয়ত, মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারের প্রতি অবমাননা করেছেন। তৃতীয়ত, তাঁরা একজন মহিলার সঙ্গে অসভ্যতা করেছেন। এই সবকটিই বিজেপি (BJP) র সংস্কৃতির সঙ্গে ভীষণ ভাবে মানানসই, এতে সন্দেহ নেই। সুভাষচন্দ্র কী, তাঁরা জানেন না। জীবনে ‘তাইহোকু’ কথাটা শোনেননি। সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে রামচন্দ্রের কী যোগাযোগ, সেটাও পরিষ্কার নয়। তবু এই কপিকুল ল্যাজ তুলে ‘ঊপ-ঊপ’ শব্দে জয় শ্রীরাম বলেছেন।
এমনকি তাঁরা রামচন্দ্রকেও বোঝেন না। উত্তর ভারতীয় আর্য রামের সঙ্গে পূর্ব ভারতের রাম, অর্থাৎ কৃত্তিবাসী রামায়ণের রাম যে আলাদা, তা তাঁরা বোঝেন না। কৃত্তিবাসের রাম একান্ত ভাবেই বাঙালি। কৃত্তিবাস ঘোষণা করেছিলেন যে এই ‘নরচন্দ্রমা’ নিতান্ত ভাবেই বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। কৃত্তিবাসের রাম তাই কদমা খেতে ভালবাসেন। মুড়ি-মুড়কি খেতে ভালবাসেন। মাছের ঝোল তাঁর ভাল লাগে। তিনি লব-কুশের দায়িত্ববান পিতা। তিনি স্ত্রীকে অগ্নিপরীক্ষায় পাঠান না, বরং নারী জাতিকে একান্ত ভাবে সম্মান করেন। এমনকি, কৃত্তিবাসের রাম কিছুটা স্ত্রৈণ, স্ত্রী-কে ভয় পান।
কৃত্তিবাসী রামের এই যে আর্কিটাইপ, এটা উত্তর ভারতের আর্য রাম, যা সাহিত্যের ভাষায় ‘বর্বর’, অনেক বেশি রুক্ষ, বাংলার রাম স্বভাবতই সেটা নন। কেননা এখানে রামের যে বিবর্তন হল, তার পিছনে বৈষ্ণব আন্দোলনের একটা ভূমিকা আছে। বৈষ্ণব ভাবান্দোলন ও চৈতন্যের সর্বধর্ম সমন্বয় রামকে অনেক বেশি সহনশীল করেছে। রামকে অনেক বেশি ক্ষমাশীল ও সহিষ্ণু করেছে। বাঙালি রাম একান্ত ভাবেই বঙ্গজ উপাদানে পরিপূর্ণ। এই স্ত্রী জাতিকে সম্মান করা যে রামচন্দ্র, তাঁকে উত্তর ভারতের নারীবিরোধী রামচন্দ্রের বোঝার কথা নয়। ফলে, বাঙালি রামের যে মাহাত্ম্য, সেটা তাঁরা বোঝেননি। স্বভাবতই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও (Mamata Banerjee)তাঁরা বুঝতে পারছেন না। এই যে পরিবর্তিত রাম, বাঙালি রাম, একে যে দিন ওঁরা যথার্থ ভাবে বুঝতে পারবেন, তার পর ওঁরা বাংলায় জয় শ্রীরাম বলুন।
ওঁদের মধ্যপ্রদেশ থেকে আসা বিজেপি নেতা বলছেন, ‘এটা স্বাগত জানানো’! আমার ধারণা মধ্যপ্রদেশের রাজনীতিবিদরা যখন ব্যাট দিয়ে সরকারি লোককে মারেন, তখনও প্রত্যেক ব্যাটের মারের সঙ্গে সঙ্গে জয় শ্রী রাম বলেন। একবার ব্যাট দিয়ে মারেন, একবার বলেন জয় শ্রী রাম। একবার খুন করেন, তার পর বলেন জয় শ্রী রাম। এই যে হত্যার ভাষা, খুনের ভাষা, হুমকির ভাষা, এ কখনও স্বাগত জানানোর ভাষা হতে পারে না।
আমি ওই মধ্যপ্রদেশ (Madhyapradesh) থেকে আসা বা মধ্যভারত থেকে আসা নেতাদের খোলাখুলি চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি, একদিন নেতাজি সুভাষচন্দ্রকে নিয়ে আমি আলোচনা করতে চাই। তাঁরা নেতাজিকে কতটা বোঝেন? কী বোঝেন? আমার ধারণা তাঁরা এই চ্যালেঞ্জে রাজি হয়ে যাবেন, কারণ তাঁদের সামনে নেতাজি বলতে সুভাষচন্দ্র বসু ভেসে ওঠেন না, তাঁদের সামনে নেতাজি বলতে যাঁর মুখ ভেসে ওঠে, তিনি হলেন, তাঁদের প্রধানমন্ত্রী।
(লেখক রাজ্যের মন্ত্রী)