কেন এভাবে দিনযাপন জাপানের এই দ্বীপবাসীদের?
এক বছর আগেও যা অলীক বলে মনে হত, এখন সেটাই বাস্তব। রাস্তায় নামলে চোখে পড়ে কেবলই মুখোশের সারি। বিখ্যাত কবিতার লাইন সামান্য বদলে বলতে ইচ্ছে করে, এই মাস্ক উপত্যকা আমার দেশ নয়। গোটা পৃথিবীটাই অতিমারির খপ্পরে পড়ে এক প্রকাণ্ড মাস্কের আড়ালে লুকিয়ে পড়েছে। আবার কবে মানব সভ্যতা পুরোপুরি স্বাভাবিক চেনা ছন্দে ফিরবে, তা সময়ই বলবে। কিন্তু একটা কথা হলফ করে বলা যায়, এই নীল রঙের গ্রহ আবার সুস্থ হয়ে উঠলেও পৃথিবীর এক কোণে থাকা এক দ্বীপে কিন্তু থেকেই যাবে মুখোশের রাজত্ব। জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে ১৬০ কিমি দূরে থাকা সেই দ্বীপের নাম মিয়াকেজিমা।
করোনা নামের দুঃস্বপ্নের জন্ম হওয়ার বহু আগে থেকেই এই দ্বীপের মানুষদের ‘মুখ ঢেকে যায়’ মুখোশে! গ্যাস মুখোশ। আচমকা দেখলে মনে হবে কল্পবিজ্ঞানের কোনও ডিস্টোপিয়ার দেশ বুঝি। কিংবা কোনও বদখত রুচির কস্টিউম পার্টি চলছে। আসলে তো তা নয়। এখানকার মানুষের জীবনের ‘চেনা দুঃখ চেনা সুখ’ সব কিছুর সঙ্গেই ওতপ্রোতভাবে মিশে রয়েছে গ্যাস মুখোশের অস্তিত্ব। সে আপনি যেখানেই থাকুন না কেন, মুখোশ ছাড়া চলতে পারবেন না। বলা ভাল, চলতে চাইবেন না। কেননা বছর কুড়ির আগের সেই দিনগুলো বারবার হানা দিতে থাকবে স্মৃতিতে। আর তখনই মনের মধ্যে দানা বাঁধবে ভয়। আশঙ্কা। আতঙ্ক!
কী হয়েছিল ২০০০ সালে? সেকথা বলার আগে জায়গাটার ভূগোলটা একটু চিনে নেওয়া যাক। জাপানের আইজু দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম ৫৫.৫০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই দ্বীপের চারপাশে রয়েছে রীতিমতো সক্রিয় আগ্নেয়গিরি। কিছু বছর অন্তর আগ্নেয়গিরির জেগে ওঠাটা সেখানে অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। গত শতাব্দীতে ছ’বার সেখানে অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু সব সীমা ছাড়িয়ে যায় নতুন সহস্রাব্দের শুরুতে।
২০০০ সালে মাউন্ট ওয়ামায় এমন বিস্ফোরণ হল যে ২৬ জুন থেকে ২১ জুলাই পর্যন্ত সাড়ে সতেরো হাজার বার ভূমিকম্প হয়ে চলল মিয়াকেজিমায়! মাটিতে দেখা গেল ফাটল। আর সেই সঙ্গে বিষিয়ে গেল বাতাস। পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল দৈনিক ৪২ হাজার টন পর্যন্ত সালফার ডাই অক্সাইড ছড়িয়ে পড়তে লাগল হাওয়ার ভিতরে। মাথার প্রায় ১০ মাইল উপর পর্যন্ত জেগে থাকল ধোঁয়ামেঘের কুণ্ডলী। মাটির ভিতর থেকেও গ্যাস বেরনোর কথা শোনা গেল। বোঝাই যাচ্ছে, এমন ভয়ংকর পরিস্থিতিতে কোনও মানুষের পক্ষেই এখানে থাকা সম্ভব ছিল না। তাই হল। প্রশাসনের তৎপরতায় দ্রুত খালি করে ফেলা হল দ্বীপ। নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল দ্বীপের সমস্ত বাসিন্দাকে। তবু তারপরও… ‘কিছু মায়া রয়ে গেল’।
২০০৫ সালে আবার ফিরতে শুরু করলেন মিয়াকেজিমার বাসিন্দারা। শহরজুড়ে তখন মৃত গাছ, ফেলে যাওয়া পরিত্যক্ত গাড়ি আর শুনশান পথঘাট। আবারও ঘুম ভেঙে জেগে উঠল সেই দ্বীপ। ফেলে যাওয়া ঘরবাড়ি আবারও সরগরম হল চেনা মানুষের ছোঁয়ায়। কিন্তু… সব কিছু অবিকল আর আগের মতো রইল না। কেননা ততদিনে সকলের মুখে উঠেছে গ্যাস মুখোশ। লক্ষ্য, বাতাসের সালফার ডাই অক্সাইড যেন ছোবল না মারতে পারে।
প্রথম প্রথম কেউ কেউ অসুস্থও হলেন। সরকারও চাইল ফের তাঁদের সরিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু এবার আর অধিকাংশ মানুষই এখান থেকে যেতে রাজি হলেন না। আঁকড়ে ধরলেন নিজের পুরনো বাড়ি, চেনা মহল্লাকে। এ এক আশ্চর্য প্রত্যাবর্তনের কাহিনি। তবে হ্যাঁ, সকলে ফেরেননি। কিন্তু অধিকাংশই ফিরেছেন। আগে ছিলেন ৩,৬০০ জন। এখন প্রায় ২,৯০০।
জীবন গিয়েছে চলে কুড়ি কুড়ি বছরের পার। ২০০০ সালের দুঃস্বপ্ন এখনও নিশ্চয়ই তাড়া করে। তবু তার মধ্যেই গ্যাস মুখোশকে জীবনের অঙ্গ করে এখানেই বেঁচে রয়েছেন মিয়াকেজিমার মানুষরা। খেয়াল রেখেছেন অ্যালার্ম সিস্টেমের দিকে। বাতাসে সালফার ডাই অক্সাইড বাড়তে শুরু করলেই জানান দেয় সেই অ্যালার্ম। অবশ্য অ্যালার্ম যখন বাজে না, তখনও মানুষ মুখ ঢেকে রাখেন গ্যাস মাস্কে। কেননা দ্বীপের বাতাস পুরোপুরি স্বাভাবিক কখনওই থাকে না। টোকিও প্রশাসনও লাগাতার হেলিকপ্টারে চক্কর দেয় দ্বীপের আকাশে।
কী ভাবছেন? নিজের চোখে একবার দেখতে চান? চলে আসুন। তবে তার আগে পরীক্ষা করে দেখতে হবে আপনার ফুসফুস পুরোপুরি সুস্থ কিনা। তারপরই আবেদনের সুযোগ মিলবে। প্রতি বছরই অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় বহু পর্যটক পাড়ি জমান এদেশে। সমুদ্রের কোলে ছোট্ট দ্বীপটা এমনিতে বেশ সুন্দর। কিন্তু তাতে ভুললে চলবে না। পিঠের ব্যাগে যা খুশি নিন। গ্যাস মুখোশ নিতে যেন ভুল না হয়। আর যদি ভুলেও যান, অসুবিধা নেই। এখানে এসে পৌঁছলেই গুচ্ছের দোকানে কিনতে পাবেন গ্যাস মুখোশ। তারপর আপনিও মিশে যেতে পারবেন দ্বীপের মানুষদের ভিতরে। মুখোশের সাম্যে হয়ে উঠবেন ওঁদেরই একজন। অনুভব করবেন বিখ্যাত বাংলা জীবনমুখী গানের লাইন কেমন মিশে আছে এখানকার বাতাসে। ‘পারো যদি দেখে যেও বেঁচে থাকা কারে বলে’।