মরিচঝাঁপি ইতিহাসের সব থেকে কালো অধ্যায়
১৯৭৯ সালের ৩১শে জানুয়ারি। মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ড। বাঙালি জাতির এক কালো অধ্যায়। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের বর্বরতাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিল স্বাধীন ভারতে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর শাসনকালে মরিচঝাঁপি হত্যাকাণ্ড।
মরিচঝাঁপির ঘটনার শেকড় প্রোথিত সেই ১৯৪৭ সালের দেশভাগে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাও দ্বিখণ্ডিত হয়। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন থেকে পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও নানা নির্যাতনের শিকার সংখ্যালঘু হিন্দুরা উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নিতে থাকে।
প্রথমদিকে আসা উদ্বাস্তুরা কলকাতা-সহ পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য স্থানে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হলেও পরের দিকে, অর্থাৎ ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে বিপুল সংখ্যক দলিত নমঃশূদ্র পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের বাইরে মধ্যপ্রদেশ-উড়িষ্যা সীমান্ত-সংলগ্ন দণ্ডকারণ্য, আন্দামান-সহ দূরবর্তী ও অবাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন স্থানে বহু নমঃশূদ্র পরিবারকে পুনর্বাসন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
কিন্তু, নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুরা বাংলা ছেড়ে দণ্ডকারণ্যে যেতে রাজি ছিল না। কারণ, বাঙালি সংস্কৃতি থেকে বহুদূরে অবস্থিত জনবিরল দণ্ডকারণ্যের পাথুরে মাটি, জলের অভাব, তীব্র গরম নমঃশূদ্র কৃষক উদ্বাস্তুদের বসবাসের অনুপযুক্ত ছিল। কিন্তু, কেন্দ্রীয় সরকার উদ্বাস্তুদের দাবিকে উপেক্ষা করে বহু নমঃশূদ্র উদ্বাস্তু পরিবারকে বলপূর্বক দণ্ডকারণ্য-সহ পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহু দূরের কয়েকটি স্থানে পুনর্বাসনে পাঠিয়ে দেয়।
সেখানে কিছুদিন বসবাস করেই উদ্বাস্তুরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। বাংলাভাষাহীন দণ্ডকারণ্যের গভীর জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় পানীয় জলের অভাব, ম্যালেরিয়া-ডায়রিয়া-সহ বিভিন্ন রোগের প্রাদুর্ভাবে নিত্যদিন মৃত্যুর ঘটনা ঘটতে থাকে। এর মধ্যে ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দণ্ডকারণ্যের একটি ক্যাম্পে সেনার গুলিতে কয়েকজন উদ্বাস্তু নিহত এবং অনেকে আহত হন। জ্যোতি বসু ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে মধ্যপ্রদেশের (বর্তমান ছত্তিশগড়) ভিলাই শহরে গিয়ে দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তু নেতাদের প্রতিশ্রুতি দেন যে, তারা পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় এলে দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গে ফিরিয়ে নেওয়া হবে এবং সুন্দরবনে তাদের পুনর্বাসনের দাবি পূরণ করা হবে।
উদ্বাস্তু ভোটব্যাঙ্কের উপর ভিত্তি করে কিছুদিনের মধ্যেই ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসে। বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী হন জ্যোতি বসু। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে দণ্ডকারণ্যের উদ্বাস্তুদের মধ্যে আনন্দ-উৎসবের ঢেউ খেলে যায়। তারা দ্রুত পশ্চিমবঙ্গে ফেরার স্বপ্নে বিভোর হয়ে ওঠেন।
১৯৭৭ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার উদ্বাস্তু পরিবার দণ্ডকারণ্য ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসে। সুন্দরবনাঞ্চলের প্রায় পরিত্যক্ত জনবিরল মরিচঝাঁপি দ্বীপে আশ্রয় নেয় এবং অস্থায়ী আস্তানা গড়ে তুলে বসবাসও শুরু করে দেয়।
কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর মুখোশ খুলতে খুব দেরি হয়নি। তাঁর সরকার এই নমঃশূদ্র উদ্বাস্তুদের পশ্চিমবঙ্গের বোঝা হিসেবে চিহ্নিত করে রাজ্যে তাদের বাস করতে দিতে অস্বীকার করে।
এই পরিস্থিতিতে জ্যোতি বসু অত্যন্ত নির্দয় হয়ে ওঠেন। তিনি দণ্ডকারণ্য থেকে আসা উদ্বাস্তুদের বাংলায় প্রবেশ পুলিশ দিয়ে আটকে দেন, বিভিন্ন উদ্বাস্তুকে গ্রেপ্তার করেন, বাকিদের জোর করে দণ্ডকারণ্যে ফিরিয়ে দেন। আবার অনেক উদ্বাস্তুই পুলিশী ঘেরাটোপ এড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকে পড়ে।
মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে মরিচঝাঁপি দ্বীপের ক্ষুধার্ত, অসহায়, রুগ্ন, শতছিন্ন বস্ত্র পরিহিত উদ্বাস্তুদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস শুরু করলেন। মরিচঝাঁপি দ্বীপে খাদ্য, পানীয় জল, ঔষুধপত্র, পাউরুটি প্রভৃতি সবই পাশের কুমিরমারি ও অন্যান্য দ্বীপ থেকে যেতো।
উদ্বাস্তুরা যাতে নদী পেড়িয়ে পাশের কুমিরমারি গ্রাম থেকে খাদ্য, জল, ঔষুধ না আনতে পারে তার জন্য কোরানখালি নদীতে পুলিশি প্রহরা বসানো হয়। অনেকে অনাহারে, অনেকে ঔষুধপত্রের অভাবে ম্যালেরিয়া-ডায়রিয়ায় মারা যায়। ভারত সেবাশ্রম সংঘ, রামকৃষ্ণ মিশন প্রভৃতি সেবামূলক সংগঠনগুলি মরিচঝাঁপির মানুষগুলিকে সাহায্য করতে এগিয়ে গেলে সরকার তাদের সেখান থেকে জোর করে ফিরিয়ে দেয়।
অবরোধের দশম দিনে, মরিচঝাঁপির ১৬জন মহিলা নৌকায় করে পাশের কুমিরমারি গ্রাম থেকে খাদ্য, পানীয় জল আনতে রওনা দেয়। উদ্দেশ্য ছিল যে, মুমুর্ষু নারীদের দেখে সরকারের-প্রশাসনের অন্তত দয়া হবে। কিন্তু পুলিশ দ্রুত একটি লঞ্চে এসে নারীদের নৌকাটি ডুবিয়ে দেয় এবং দুজন মহিলাকে তুলে নিয়ে গিয়ে পুলিশ তীব্র শারীরিক নির্যাতন চালায়। এভাবে ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের কয়েকদিনে প্রচুর উদ্বাস্তুকে সরকার হত্যা করে।
তাতেও উদ্বাস্তুরা বাংলার মাটি ছেড়ে, মরিচঝাঁপির মাটি ছেড়ে দণ্ডকারণ্যে ফিরতে রাজি হয়নি। এরপর জ্যোতি বসু পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য আস্তিন গোটাতে শুরু করেন। তাঁর সরকারের নির্দেশে ১৯৭৯ সালের ৩১ জানুয়ারি পুলিশের বিশাল বাহিনী মরিচঝাঁপি দ্বীপে ঢোকে এবং উদ্বাস্তুদের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করতে থাকে।
হত্যার পর পুলিশ ও জ্যোতি বসুর পার্টির কর্মীরা মৃতদেহগুলি নদীর জলে ফেলে দেয়। তারা কুমীর ও মাছের খাদ্য হয়ে যায়। অনেক উদ্বাস্তু নৌকাযোগে পাশের কুমিরমারি গ্রামে পালাতে গেলে পুলিশ নৌকাতেই এলোপাথাড়ি গুলি চালালে সেখানে অনেকের মৃত্যু হয়। গুলিবর্ষণ থেকে বাঁচতে অনেকে জলে ঝাঁপ দিলে তারা কুমিরের পেটে যায় বা জলে ডুবে মৃত্যু হয়। আর যারা জঙ্গলে পালায় তারা বাঘের পেটে যায়।
এভাবেই রচিত হয় বাংলার ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় মরিচঝাঁপি আজ হারিয়ে গেছে।