যতদিন সাঁওতালি ভাষা থাকবে ততদিন উজ্জ্বল থাকবে পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মুর অবদান
সাঁওতাল জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য, সাঁওতালি সাহিত্যের ক্ষেত্রে যাঁর বদান অনস্বীকার্য, সেই পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু পৃথিবীর বুকে আবির্ভাব হয়েছিলেন ১৯০৫ সালের ৫ই মে। সাধু রামচাঁদ মুর্মু যে স্বপ্ন নিয়ে সাঁওতাল জাতির ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু ” অলচিকি আন্দোলন” সেই ভিত্তি প্রস্তর উপর সুসংহত ভাবে স্থাপন করলেন।
পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মুর জন্ম- ওড়িষা রাজ্যের ময়ূরভঞ্জ জেলার রায়রংপুর নিকট ডাহারডি( ডাণ্ডবোস) গ্রামে। পিতার নাম -নন্দলাল মুর্মু (সিদ)।মাতার নাম সালমা মুর্মু। রঘুনাথ মুর্মু কে ‘চুনু’ বলে ডাকা হতো। সাত বছর বয়সেই গাঙারিয়া ইউ.পি.স্কুলে তাঁর পড়াশুনা শুরু হয়। পরে বহড়দা এম.ই.স্কুলে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়। বহড়দা স্কুল থেকে এম.ই.পাশ করে বারিপাদা হাই স্কুলে ভর্তি হন।সেখানে হোটেলে থেকে পড়াশুনা করেন। সেখান থেকেই মেট্রিক পাশ করেন।
বাল্যকালে তাঁকে উড়িয়া ভাষাতে পড়তে হয়েছে। তিনি উড়িয়া ভাষা একেবারেই বুঝতে পারতেন না। তিনি তখন থেকেই বলতেন কেন সাঁওতালি ভাষায় লেখাপড়া হচ্ছে না।তখনই বুঝতে পেরেছিলেন সাঁওতালি ভাষার কোন কোন অক্ষর নেই। বহড়া এম .ই.পড়ার সময়, অন্য ছেলেরা যখন খেলাধুলায় মেতে থাকত,তখন তিনি একাই বসে বসে কি সব যেন আঁকতেন। আর সেগুলো তৈরি করতেন।
ছাত্রাবস্থায় তিনি বুঝতে পেরেছিলেন সাঁওতাল গন আছেন- উড়িষ্যা, বিহার, বাংলা, অসম সহ বিভিন্ন প্রদেশে। এঁদের মধ্যে একতা না থাকাতে বিভিন্নভাবে থাকার জন্য, বঞ্চনার জন্য, প্রতারণার জন্য, লেখাপড়া না জানার জন্য, শিক্ষার আলো না পাওয়ার জন্য, অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কারে ডুবে থাকার জন্য- আর্যগণ তাঁদেরকে ঘৃনা করতেন।উনি বুঝতে পেরেছিলেন, ভাবতেন-সাঁওতালগন লেখাপড়ায় শিক্ষিত হয়ে উঠলে সাঁওতালদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন হবে। আর সেটা সম্ভব একমাত্র সাঁওতালি ভাষাতে, মাতৃভাষাতে। আর তার জন্য প্রয়োজন নিজস্ব লিপি। অলচিকি। যেটা সকল সাঁওতালদের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে সাহায্য করবে। ১৯২৪ সালের অনেক দুঃখ কষ্ট, জ্বালা যন্ত্রণা সহ্য করে বারিপাদা হাই স্কুলে পড়ার সময়ে সাঁওতালি ভাষার উপযোগী লিপি সৃষ্টি করেন।
নিজের কাজকর্মর পাশাপাশি সাহিত্য চর্চার কাজেও পিছিয়ে ছিলেন না রঘুনাথ মুর্মু। লোককে আনন্দ দেওয়ার জন্য, সমাজের মঙ্গলের জন্য তিনি সাহিত্য চর্চা করেছিলেন। তিনি জানতেন সাঁওতাল জাতি সঙ্গীত খুব পছন্দ করেন।তাই তিনি প্রথম রচনা করেন আর ১৯৩৬ সালে ” হর সেরেঞ ” নামক সাঁওতালি সঙ্গীতের আর বই বাংলা অক্ষর প্রকাশ করেন। তারপর বিভিন্ন পুস্তক রচনা করে সাঁওতালি সাহিত্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করে যান।
পণ্ডিত রঘুনাথ মুর্মু ছিলেন উদার মনের মানুষ। অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর। তিনি ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক, সংস্কৃতি প্রিয়, মাতৃভাষা পূজারী। তিনি সৃষ্টিকর্তা। দার্শনিক। গবেষক। ভাষার উপর গভীর দরদ থাকার জন্য ওড়িষা আদিবাসী মহাসভা তাঁকে ” গুরু গোমকে” উপাধিতে ভূষিত করেন।সেই সময়কার উড়িস্যার উন্নয়ন মন্ত্রী-শ্রী রামজিৎ সিং বারিহা তাঁকে “A Great Orator With Charming Voice” বলেন। ওড়িষার সাহিত্য একাডেমী ১৯৭৮ খ্রীঃ Founder Of Santali Language, Literature And Inventor Of OL CHIKI হিসাবে তাঁকে বলা হয়।
শ্রী জয় পাল সিং এম. এ.(ওক্সন) এম.সি.এ. রঘুনাথ মুর্মু কে ” পণ্ডিত “উপাধি দেন।মিস্টার এম.ডি. টিগ্ গা, তাঁকে “Great Inventor And Dramatist বলেন।”The Santal” পুস্তকের লেখক খ্যাতিনামা নৃতত্ত্ব বিদ্যালয় প্রফেসর মার্টিন ওঁরাও,কালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পণ্ডিত কে Spiritual Guru বলেন। ধমকুড়িয়া, রাঁচি নামক এক সংস্থা তাঁকে “Doctorate in Literature (ডি.লিট) উপাধি দেন।১৯৭৯ সালের ১৭ই নভেম্বর পুরুলিয়া হুড়া থানার কেন্দবনা ময়দানে এক লক্ষেরও বেশি মানুষের সম্মুখে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মাননীয় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু মহাশয় গুরু গোমকেকে তাঁর অবদানের জন্য ” তাম্র ফলক” আর “মানপত্র” দিয়ে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন।
পণ্ডিত! অলগুরু! গুরু গোমকে! রঘু নাথ মুর্মু! ১৯৮২ সালের ১লা ফেব্রুয়ারী সকাল আট ঘটিকায় এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে বিদায় নেন।