সরাসরি সুপ্রকাশ
সুপ্রকাশ গিরি – পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সভাপতি। অধিকারী পরিবারের বিরোধী শিবিরের নেতা বলেই পরিচিত রামনগরের বিধায়ক অখিল গিরি (Akhil Giri)। সুপ্রকাশ তাঁরই পুত্র।
শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যাওয়ার ফলে কি গুরুত্ব বাড়লো তাঁর? শুভেন্দুর (Suvendu Adhikari) বিরুদ্ধে নন্দীগ্রামের মাটিতে কতটা কঠিন হবে লড়াই? মুখ্যমন্ত্রী নিজে লড়তে চলেছেন পূর্ব মেদিনীপুর থেকে। কতটা আত্মবিশ্বাসী সুপ্রকাশ?
দৃষ্টিভঙ্গির সাথে খোলামেলা আলোচনায় সুপ্রকাশ গিরি:
প্রশ্ন: এই জেলাতে শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে চলে গেলেন বলে কি কোথাও আপনার রাজনীতির পথ কিছুটা সুগম হল?
সুপ্রকাশ: এরকম কিছুই না। শুভেন্দু অধিকারী যখন ছিলেন, তখনও আমি তৃণমূল যুব কংগ্রেসের দায়িত্বে ছিলাম। ওয়ার্কিং প্রেসিডেন্ট হিসেবে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে তৃণমূল যুব কংগ্রেসকে সংগঠিত করা চেষ্টা করেছি। শুভেন্দু অধিকারী যুব সমাজকে কাজ করতে দিতেন না। যুবদের বাড়তি উদ্দীপনা, উচ্ছাস এবং প্রেরণা আমরা কোনদিনই তাঁর কাছ থেকে পাইনি। তিনি যুব সমাজকে একত্রিত করার জন্যে কোনদিনই আমাদের সহযোগীতা করতেন না। যুবদের মাস মুভমেন্টকে তিনি সবসময় বাধা দিয়েছেন। সেই বাধা পেরিয়ে আমরা এসেছি।
আমরা যাকে দেখে রাজনীতি করি, তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। শুভেন্দু যতোই বাঁধা দিতেন, আমরা সেই বাঁধা পেরিয়ে, দলের কাজ করতাম। তাঁর চলে যাওয়ায় আমার বাড়তি কোন সুবিধা না হলেও, আজ যুবরা আবার রাস্তায় বেরিয়ে দলের কাজ করছেন। তিনি মেদিনীপুরের মাটির সাথে যা করেছেন, তা মীরজাফরের কাজের সমান। এখন আমরা কোথাও গেলে আমাদের লোকে বেইমানের মাটি বলে। এই মাটি ত্যাগ, আদর্শের কথা বলে। সব কিছুকে ছেড়ে এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে। নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করতে উনি এমন কারো পায়ে হাত দিচ্ছেন, যে মানুষদের বাংলায় কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই।
প্রশ্ন: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এসে বলেছেন এখানকার মানুষ কখনো শিরদাঁড়া ঝুকিয়ে দেননি। উনি বলেছেন অধিকারী গড় আবার কি? এইরকম কোন বিষয় নেই। এটা আপনাকে এবারের ময়দানে কতোটা উদবুদ্ধ করছে?
সুপ্রকাশ: মানুষ সঙ্গে না থাকলে অধিকারী গড় বলে কিছু হয় না। ওই পরিবার আমাদের এই জেলাকে লিজ নিয়ে নিয়েছিল। কংগ্রেস যখন ক্ষয়িষ্ণু অবস্থায়। ১৯৯৬ সালে কাঁথি লোকসভা কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সম্মানীয় নীতিশ সেনগুপ্ত। তাঁকে কাঁথিতে গাড়ি থেকে নামিয়ে মাথায় ঘোল ঢেলে দেওয়া হয়েছিল। তিনি ছিলেন একজন আইএএস অফিসার। কংগ্রেস ছাড়ার মুখে এভাবেই তাঁরা কংগ্রেসিদের অপমান করেছিলেন। আবার ঠিক যখন তৃণমূল কংগ্রেস থেকে তাদের সবকিছু নেওয়া হয়ে গেছে, সব চাহিদা মিটে গেছে, তখন দল ছাড়ার সময় যার দয়ায় এত দূর এসেছে সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অপমান করছে।
ওরা অন্যের পরিবারকে প্রাইভেট লিমিটেড বলছে, যাদের নিজেদের পরিবারেই চার পাঁচটা লিমিটেড আছে। ওটাই একটা লিমিটেড কোম্পানি হয়ে গেছে। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অন্য কাউকে সেই পদে বসতে দেওয়া হয়নি। জোড়পূর্বক কাঁথি পৌরসভার চেয়ারম্যান যোগ্যতা নেই তাও এসেছে। অনেক সিনিয়র কাউন্সিলরদের সেই পদে বসতে দেওয়া হয়নি। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রকে কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই সেই পদে বসানো হয়েছে। তমলুকেও তাঁর বাড়ির লোককে নির্বাচিত সাংসদ করা হল? কেন তমলুকের কি কোন যোগ্য লোক নেই? উনি বারবার সতীশ সামন্তদের কথা বলেন। তিনি কি তমললুকের মাটিকে অপমান করেননি?
প্রশ্ন: সবাই জানেন অধিকারীদের সঙ্গে আপনাদের আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে। যদিও বরবারই বলেছেন আপনারা কোণঠাসা হয়ে এসেছে। এবার যে পরিস্থিতিটা তৈরি হল, সেটাকি আপনারা মাঠে নেমে বুঝে নেবেন? ‘
সুপ্রকাশ: আমরা মাঠেই ছিলাম। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলায়, যিনি তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি আর কেউ নন, তিনি আমার বাবা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতোই তিনিই আমার আদর্শ। তাঁর রাজনৈতিক জীবন দেখলে সেটা বোঝা যায়। তিনি ৪০ বছর ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে আছেন। কখনো তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাইরে যাননি। অনেক কিছুই পাননি। রাজনীতিতে সবটাই চাওয়া পাওয়া নয়। রাজনীতি মানে অনেকটাই ত্যাগ। মানুষের জন্যে ছেড়ে দেওয়ার কিছু কাজ। অনেকাংশেই তিনি অবহেলিত হয়েছেন। সারা জেলা হাতের তালুর মতো তিনি চেনেন। দলের এই সময় তিনি দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পিছনের সারীতে থেকে।
প্রশ্ন: আপনাকে ভোটের আগে অখিল গিরি কী কী টিপস দিচ্ছেন বাবা হিসেবে?
সুপ্রকাশ: আমরা খানিকটা পিছিয়ে পড়েছিলাম। যুব সমাজকে একত্রিত করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নকে পাথেয় করে যাতে বাংলাফ্র নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে সেটাই আমাদের টার্গেট। বিভিন্ন জায়গায় মাঠে ঘাটে পোগ্রাম করে আমরা সবাইকে বোঝানোর চেষ্ঠা করছি। মানুষকে বোঝানোর চেষ্ঠা করছি। শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তৃতীয়বারের জন্যে মুখ্যমন্ত্রী করাই লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য বাংলাকে রক্ষা করা। যারা বাংলাকে ভেঙে দেওয়ার কথা বলছে, যারা ধর্মের ভেদাভেদের কথা বলছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে যারা যুবসমাজকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদেরকে আদর্শ করে, আমরা লড়াই করার চেষ্ঠা করছি।
প্রশ্ন: আপনি বলছেন মাঠে ময়দানে নেমে মানুষকে বোঝাচ্ছেন। এই যে বোঝাতে হচ্ছে, কোথাও কি লাইনচ্যূত হয়ে যাচ্ছিলেন সাধারণ মানুষ জন? অনেকেই মনে করছেন শুভেন্দু অধিকারীর অনুগামী প্রচুর হতে প্যাঁরে জোড়া ফুলের থেকে পদ্ম ফুলে বেশি ভোট যাবে। কি মনে করেন?
সুপ্রকাশ: আমি এই জেলার কথা বলতে পারি। গতকালের জনসভাতেও যে মানুষের সুনামি হয়েছে, মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে মুখ্যমন্ত্রী এবং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় আসেন এই জেলায়। নেত্রী আসবেন এটা সবার কাছেই খুব আবেগের। মানুষ আবেগের বশে গেছেন। কিন্তু অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমাণ করলেন, পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় মানুষ এখনো তৃণমূল কংগ্রেসের সাথেই আছেন।
শুভেন্দু বাবুর চলে যাওয়া আমার মনে হয় না কোন এফেক্ট ফেলতে পেরেছে। তাঁর প্রভাব, প্রতিপত্তি প্রচুর, তিনি পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিক কটা মানুষ তাঁর সঙ্গে গেছেন। ১৩ জন বিধায়কের মধ্যে মাত্র একজনকে নিয়ে যেতে পেরেছেন। তাও এমন একজন যার সাথে মানুষের কোন যোগাযোগ নেই। বিচ্ছিন্ন বিধায়িকা ছিলেন। এলাকায় যেতেন না। করোনা আম্পানের সময় তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এবার হয়তো টিকিটই পেতেন না। সেই ধরণের বিধায়ক, বিধায়িকাদের নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এর আগে বলেছিলেন ডিসেম্বরে তৃণমূল দলটা পড়ে যাবে। জানুয়ারিতে ১০০ এমএলএ নিয়ে বিজেপিতে যোগ দেবেন, কোনটাই ঘটেনি। বরং শুভেন্দু বাবু চলে যাওয়ার পরে জেলায় আগের থেকে অনেক বড় বড় রাজনৈতিক কর্মসূচী হচ্ছে।
প্রশ্ন: জয়ী হলে, কী কী কাজ করবেন বলে ভেবেছেন?
সুপ্রকাশ: এ জেলার বাড়তি পাওনা আমাদের জেলা থেকে এবার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হবেন। নন্দীগ্রামের (Nandigram) মাটি থেকে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করবেন এবং আমরা আশাতীত, অবিভক্ত মেদিনীপুরের ৩৫ টি আসনই আমরা তাঁকে উপহার দিতে পারব। এটা একটা বাড়তি পাওনা এই জেলা থেকে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিগত আট বছরে আমাদের জেলাকে যা দিয়েছেন, যেভাবে সাজিয়েছেন। হলদিয়ায় যেমন শিল্প নগরী আছে, পর্যটন শিল্প আছে দীঘায়। হলদিয়া এবং দীঘাকে কেন্দ্র করে, অর্থনৈতিক বিভিন্ন পথ খুলে গেছে। দীঘার পর্যটন শিল্পকে কোন জায়গায় নিয়ে গেছেন মুখ্যমন্ত্রী। দীঘাকে তিনি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন শিল্প করেছেন। মৎসজীবী, কাজু ব্যবসায়ী, ঝিনুক- মাদুর শিল্পী, বহু মানুষ এইসব শিল্প থেকে জীবিকা অর্জন করেন। দীঘা- তমলুক রেললাইন করেছেন। তাজপুর বন্দরের কাজ শুরু হয়ে গেছে।
মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন হলদিয়ার সাথে নন্দীগ্রামের মানুষের যোগাযোগ স্থাপনে হলদিয়া- তাজপুর ব্রীজ তৈরি হবে। তাজপুর বন্দরকে সামনে রেখে যদি এখানে একটা মৎস করা যায় সেই পরিকল্পনা আছে আমাদের। কাজু ব্যবসাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। ভগবানপুরে চুলের ব্যবসা হয়। সেটাও আন্তর্জাতিক মানের ব্যবসা। এখান থেকে বিদেশে এক্সপোর্ট হয়। এই ব্যবসাগুলিকে আরো অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী করাই আমাদের পরিকল্পনা।
মন্দারমনিতে জার্মান সংস্থার যে যৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প হচ্ছে এখানেও প্রচুর কর্মসংস্থান হবে। প্রায় ১, ০০০ কোটি টাকা খরচ করেছে রাজ্য সরকার ওই প্রকল্পে। মুখ্যমন্ত্রী যখন আমাদের জেলা থেকে হবে বাড়তি সুযোগ আমাদের অবশ্যই থাকবে।
প্রশ্ন: কখনো ইচ্ছে করেনি অধিকারী গড়কে বদলে গিরি-গড় করতে?
সুপ্রকাশ: কোন গড় নেই। মানুষের সাথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সারা বছর আছেন, তাঁর সৈনিক হিসেবে মমতা বন্দ্যোপধ্যায়ের কাজকর্ম, সরকারের প্রকল্প মানুষের কাছে তুলে ধরার চেষ্ঠা করছি। গড় মানুষের গড়। মানুষ চাইলে আপনি নেতা। মানুষ না চাইলে আপনি জিরো। মানুষ চেয়েছিলেন তাই আপনি হিরো ছিলেন। যে কর্মীরা মঞ্চ বেঁধে দিত, মাইক লাগিয়ে দিত, লোক জোগাড় করে দিত, আপনি গিয়ে ভাষণ দিতেন, সেই কর্মীরাই এখন অন্য নেতাদের মঞ্চ বেঁধে দিচ্ছেন, মাইক লাগিয়ে দিচ্ছেন। এটাই মূল। আমরা সবসময় বলেছি আমাদের দল কর্মী ভিত্তিক। যারা ভাবছেন, নেতা চলে গেলে মানুষের ওপর প্রভাব পড়বে সেটা ভুল ধারণা।
প্রশ্ন: আপনি জেতার বিষয়ে কতোটা আত্মবিশ্বাসী?
সুপ্রকাশ: রাজনৈতিক লড়াই শুধু হার জিতে হয় না। শেষ হাসি কে হাসবে এ কথা ঠিক। আমরা জেতার বিষয়ে একশো শতাংশ আশাবাদী। আগে আমরা এতো মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনা দেখিনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আসার আগেও বামফ্রন্টের সঙ্গে যে লড়াই চলছিল, তখনও আমরা এই বিস্ফোরণ আশা করতে পারিনি। কাল অর্গানাইজড ওয়েতে আমরা যে মানুষের আসার ব্যবস্থা করেছিলাম তার দ্বিগুণ মানুষ সেখানে উপস্থিত হয়েছে। এতো মানুষ কিভাবে এলেন! আমরাই অবাক। মানুষ নিজের আবেগকে সামনে রেখেই ওই জনসভায় এসেছেন। এতেই প্রমাণিত হয় তৃণমূল কংগ্রেস ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে তাঁর জনসমর্থন ছিল, আছে এবং থাকবে। মেদিনীপুর তাঁকে ভরিয়ে দেবে, এটুকু আমরা কথা দিতে পারি।