নারায়ণী রেজিমেন্ট নিয়ে বিজেপির ‘ভাঁওতা’, কোচবিহারে ক্ষোভ
মহারাজ নরনারায়ণের ভাই বীরশ্রেষ্ঠ চিলা রায় আর তাঁর নারায়ণী সেনা —৪৫০ বছর পরেও সমান প্রাসঙ্গিক। হলদিবাড়ি থেকে তুফানগঞ্জ, মাথাভাঙা থেকে সিতাই, দিনহাটা, এবারও জেলায় বিধানসভা ভোটে এই ইস্যু হতে চলেছে নির্ণায়ক ফ্যাক্টর। কারণ, নারায়ণী সেনা (Narayani Sena) নিয়ে বিজেপির ‘ভাঁওতাবাজি’ দিন দিন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। প্রথমে ভারতীয় সেনায় এই নামে পৃথক রেজিমেন্ট গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল গেরুয়া শিবির। মাস কয়েক আগে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক তথ্য জানার অধিকার আইনে (আরটিআই) করা এক প্রশ্নের উত্তরে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, এমন কোনও পরিকল্পনা তাদের নেই। তাই এবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে ফেলতে হয়েছে নয়া ‘ট্রাম্প কার্ড’—আধা-সামরিক বাহিনীতে হবে নারায়ণী সেনা রেজিমেন্ট। তবে অবশ্যই রাজ্যে বিজেপি (BJP) ক্ষমতায় এলে। আর এখানেই উঠছে প্রশ্ন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তো যে কোনও সময়ই এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তার সঙ্গে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার সম্পর্ক কী? ফলে আবারও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে গেরুয়া শিবিরের দু’মুখো অবস্থান।
জেলার ভূমিপুত্র ‘রাজবংশী-কামতাপুরী’দের মননের নায়ক শুক্লধ্বজ চিলা রায়ের নামের সঙ্গে জড়িয়ে লাখো মানুষের আবেগ। সেই আবেগ নিয়ে ‘ভোটবাক্সে’ টানাটানি শুরু হয়েছিল গত ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে। গেরুয়া শিবিরের জগৎপ্রকাশ নাড্ডা, অমিত শাহ, সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়ার দেওয়া বিস্তর প্রতিশ্রুতির শীর্ষে ছিল, নারায়ণী সেনাকে ফের কোচবিহারে প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার। সঙ্গে ঠাকুর পঞ্চানন বর্মাকে ঘিরে নানান পরিকল্পনার ‘স্বপ্ন-বুনোট’। লোকসভা ভোটের পর ২২ মাস অতিক্রান্ত। একটি প্রতিশ্রুতিও পূরণ হয়নি। এসে গিয়েছে বিধানসভা নির্বাচন। তাই আবারও বিজেপির মুখে উঠে এসেছে চিলা রায়, তাঁর সেনা ও ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার (Panchanan Barma) প্রসঙ্গ। গত ১১ ফেব্রুয়ারি কোচবিহারের রাসমেলা ময়দানে দলীয় জনসভায় যার সূচনা করেছেন স্বয়ং অমিত শাহ। যদিও সেদিনই কোচবিহার শহরজুড়ে পড়েছিল লোকসভা নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি পূরণ না হওয়ার খেদ আর শ্লেষের পোস্টার-ব্যানার।
অমিত শাহের (Amit Shah) এবারের প্রতিশ্রুতি নিয়েও আশঙ্কার মেঘ ঘনিয়েছে কোচবিহারের (Cooch Behar) আকাশজুড়ে। কী সেই আশঙ্কা? সূত্রের খবর, গত বছর ৭ আগস্ট আরটিআইয়ের মাধ্যমে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কাছে দু’টি প্রশ্ন করেছিলেন অসমের ধুবড়ি জেলার ল’কলেজের সহকারী অধ্যাপক উদয়রঞ্জন রায় প্রধানিয়া। ১) গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রায় কি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ‘নারায়ণী সেনা’ গঠনের কোনও প্রস্তাব জমা দিয়েছেন? ২) প্রতিরক্ষা মন্ত্রক কি অদূর ভবিষ্যতে এরকম কোনও রেজিমেন্ট গঠনের পরিকল্পনা করেছে? ওই সূত্রটি জানিয়েছে, গত বছরের ২৩ অক্টোবর উদয়রঞ্জনবাবুর কাছে জবাব আসে। কী ছিল সেই জবাব? প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়ে দেয়, এরকম কোনও রেজিমেন্ট গঠনের প্রস্তাব সেনার কাছে আসেনি। অদূর ভবিষ্যতেও নারায়ণী রেজিমেন্ট গঠনের কোনও পরিকল্পনা নেই। যা সামনে আসায় ‘বিব্রত’ গেরুয়া শিবির। গত লোকসভা ভোটে দেওয়া প্রতিশ্রুতি কীভাবে পূরণ করা যায়, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তার মধ্যেই ফের আসরে অবতীর্ণ হন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। কোচবিহারের জনসভায় তাঁর নতুন প্রতিশ্রুতি, বাংলায় ক্ষমতায় এসে নারায়ণী রেজিমেন্ট গঠিত হবে আধা-সামরিক বাহিনীতে।
অমিত শাহের সেই প্রতিশ্রুতিকে হাতিয়ার করে আসরে নেমে পড়েছে জোড়াফুল শিবির। দলের কোচবিহার জেলার সভাপতি পার্থপ্রতিম রায় ও গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনের নেতা বংশীবদন বর্মন রাজবংশী ভাষায় বলেন, ‘বিজেপি রেজিমেন্ট গড়েয়া রাজবংশী সমাজের হাজার গাবুড় (যুবক) লাক নাকি সেনাবাহিনীত চাকুরি দিবেন। জবাব পাইচে, ভারতের সেনাত নারায়ণী রেজিমেন্ট গড়েবার কোনও খবর নাই। আর ভবিষ্যতোত এই নাকান রেজিমেন্ট গড়েয়া তুলিবার পরিকল্পনাও নাই।’ গোটাটাই ভাঁওতা, দাবি বংশীবাবুর। পার্থবাবু আরও বলেন, ওরা (বিজেপি) প্রতিশ্রুতি দেয়, আর আমাদের নেত্রী তা পূরণ করে দেখান। ইতিমধ্যেই নারায়ণী সেনার নামে রাজ্য পুলিসের একটি ব্যাটালিয়ন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মেখলিগঞ্জে তার সদর দপ্তর তৈরির কাজও শুরু হয়েছে। ভোটের জন্য নয়, গোটা বছর ধরে ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার প্রতি রাজ্য সরকারের সম্মান প্রদর্শনের নমুনা গোটা কোচবিহারবাসী জানেন। বিজেপির জেলা সভানেত্রী মালতী রাভা রায়ের অবশ্য বক্তব্য,, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যা বলেন, তাই করেন। মদনমোহনের ইচ্ছা হলেই এবার জেলাবাসীর আবেগকে মর্যাদা দিয়ে ‘নারায়ণী রেজিমেন্ট’ তৈরি হবেই।