গোখলে- তিলক এক আজন্ম শত্রুতার গল্প
What Bengal thinks today, India thinks tomorrow…বাংলা আজকে যা ভাবে ভারতবর্ষ ভাবে আগামীকাল । অর্থাত্ বাঙালিদের বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষণতা , দূরদর্শিতার নিদর্শন পরবর্তীকালে ভারতের সর্বজনস্বীকৃত হয়েছে । বাঙালি জাতির সম্পর্কে অন্যতম বিখ্যাত উক্তি । তবে উক্তিটি কোনো বাঙালির নয়, এমনকি, অনেকের জানাও নেই বক্তা কে। তিনি গোপালকৃষ্ণ গোখলে (Gopal Krishna Gokhale)। পরাধীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে,স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তিনি ছিলেন অন্যতম কাণ্ডারী ।
তবে এই পরিচয় ছাড়াও তিনি অন্য আরেক কারণেও পরিচিত । জাতির জনকের রাজনৈতিক গুরু । মহাত্মা গান্ধীর অন্যতম পথ প্রদর্শক । এবং শুধু মহাত্মা গান্ধীরই নন, অন্যধারে তিনি পাকিস্তানেরপ্রতিষ্ঠাতামহম্মদ আলি জিন্নাহেরও রাজনৈতিক গুরু । অর্থাত্ দুই যুযুধান দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের নেপথ্যে থাকা শিক্ষক, পথপ্রদর্শক ছিলেন গোপাল কৃষ্ণ গোখলে ।
১৮৮৯ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে গোখলেভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসেরসঙ্গে যুক্ত হয়ে সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যোগ দেন । রাজনৈতিক গুরু মানতেন বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারকমহাদেব গোবিন্দ রানাডেকে । ব্রিটিশ শাসনের অধীনস্থ বিচার ব্যবস্থায় ভারতীয় প্রতিনিধিদের সংখ্যা বৃদ্ধির পক্ষে দাবি জানান তিনি । পাশাপাশি বাল গঙ্গাধর তিলক,দাদাভাই নওরোজি,বিপিনচন্দ্র পাল,লালা লাজপত্ রাই,অ্যানি বেসান্তপ্রমুখ সমসাময়িক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভারতীয়দের হাতে অধিক শাসনক্ষমতা তুলে দেওয়ারও দাবি জানান । রাজনৈতিক আদর্শের বিচারে তিনি না ছিলেন নরমপন্থী, না চরমপন্থী । বরাবর মধ্যপন্থী নেতা হিসেবে থাকতেই পছন্দ করতেন । তিনি মনে করতেন, আবেদন-নিবেদন নীতিতে অধিকারগুলি আদায়ের ক্ষেত্রে বিষয়গুলির উপর ব্রিটিশদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা একান্ত প্রয়োজন ।
এত অল্প সময়ের মধ্যেই দলে এসে ক্রমে প্রথম সারিতে এগিয়ে আসা, মতাদর্শে প্রভাবিত হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকা, বিতর্ক বয়ে আনতে বাধ্য । এক্ষেত্রেও তাঁর অন্যথা হয়নি । তাঁরবিরোধিতায় বিপরীতে ছিলেন আরেক প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বাল গঙ্গাধর তিলক।
১৮৯১-৯২ সাল নাগাদ ব্রিটিশ সরকারের এজ অফ কনসেন্ট বিল নিয়ে তিলকের সঙ্গে গোখলের প্রথম মতপার্থক্যের শুরু হয় । গোখলে ছিলেন বরাবরই উদারপন্থী সংস্কারক। হিন্দুধর্মেরসংস্কার কালে তিনি বাল্যবিবাহ প্রথা রদ করার প্রচেষ্টা করেন । পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্ক বিলে কিছু বদল আনার প্রচেষ্টা করেন । বিলে প্রাপ্তবয়স্কতার মাপকাঠি হিসেবে দশ বছর থেকে বাড়িয়ে বারো বছর করা হয়েছিল । কিন্তু তিলক মহাশয় বিষয়টিকে হিন্দুধর্মের প্রাচীন রীতি রেওয়াজে ব্রিটিশ-হস্তক্ষেপ বলে মনে করেন । তবে কারণ যথাযথ হওয়ায় তিলকের বিরুদ্ধে গিয়েও গোখলে বিলের সংস্কার করান ।
তিলক (Bal Gangadhar Tilak) মনে করতেন এই ধরনের সংস্কার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী সরকারের হাতে না হয়ে স্বাধীনতার পর ভারতীয়দের নিজেদের হাতে হওয়াই বাঞ্ছনীয় । তবে তখন স্বাধীনতা আদৌ কবে আসবে সে বিষয়েই তিনি জানতেন না । যাইহোক, সে সময় তিলকের বিরোধিতা সত্ত্বেও, গোখলে ও তাঁর সহকারী সমাজসংস্কারকদের জয় হয়েছিল, বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে বিলটি আইনে পরিণতও হয়েছিল ।
সেই শুরু প্রতিদ্বন্দ্বিতার । এরই মাঝে গোখলে উদ্যোগে আইরিশ জাতীয়তাবাদী নেতাআলফ্রেড ওয়েব১৮৯৪ সালের জাতীয় কংগ্রেস অধিবেশনে এসে সভাপতিত্ব করেন । ১৮৯৫ সালে তিনি নিখিল ভারত কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদকও নির্বাচিত হন । পাশাপাশি গোখলে-তিলকের সঙ্গে কংগ্রেসের যুগ্মসচিব পদেও নিযুক্ত হন । একই সঙ্গে কাজ চলতে থাকলেও মনোমালিন্যের অবসান ঘটার কোনো লক্ষণই ছিল না ।
১৯০৫ সালে গোখলে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন । এরপর তিনি তাঁর প্রাপ্ত ক্ষমতা প্রতিদ্বন্দ্বী তিলকের ক্ষমতা খর্ব করতে ব্যবহার করেন । ১৯০৬ সালে গোখলের প্রচেষ্টায় জাতীয় কংগ্রেস সভাপতির মনোনয়ন থেকে বাদ পড়ে তিলকের নাম । শুরু হয় চাপানউতোর । একদিকে নরমপন্থী ,অন্যদিকে চরমপন্থীর মধ্যে বিবাদ । মাঝে দ্বিখণ্ডিত দিকভ্রষ্ট কংগ্রেস দল । তিলক গণআন্দোলন ও প্রত্যক্ষ বিপ্লবের মাধ্যমে ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদের ডাক দেন । অন্যদিকে গোখলে সংস্কারপন্থী হিসেবে অহিংস নীতিতে কাজ করেন ।
গোখলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এমন একজন নেতা ছিলেন যিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের থেকেও সমাজ সংস্কারে বেশি প্রাধান্য দিতেন । সে কারণেই তিনি ব্রিটিশদের সমাজ সংস্কারমূলক সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করতেন না । এই জাতীয় চিন্তাভাবনার কারণেই তিলকের মতো উগ্র জাতীয়তাবাদী নেতাদের সঙ্গে তাঁর তিক্ততার সম্পর্ক তৈরি হয় । তবে এই ধরনের বিরোধিতায় দমে না গিয়ে তিনি সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে ব্রিটিশদের সঙ্গে সহযোগিতা করেন ।
আর সেই কারণেই রাজনৈতিক দলের প্রধান পদ পাওয়ার পর তিনি সারভেন্টস অফ ইন্ডিয়া সোসাইটি স্থাপন করেন । এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার নেপথ্যেও ছিল মূল সমাজ সংস্কারের বাসনা । ভারতে শিক্ষার প্রসার। গোখলে বিশ্বাস করতেন, নতুন প্রজন্ম দেশ ও দশের প্রতি তাঁদের সাধারণ ও জাতীয় কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত না হওয়া পর্যন্ত ভারতে রাজনৈতিক পরিবর্তন আসা সম্ভব নয় । সেযুগের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতেইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস ছিল । শিক্ষার বিস্তারের জন্য তিনি এই প্রতিষ্ঠানকে যথোপযুক্ত মনে করতেন না । এই কারণে তিনি মনে করেন সারভেন্টস অফ ইন্ডিয়া সোসাইটি সেই চাহিদা পূরণ করতে পারবে । সাধারণ মানুষের জন্য লক্ষ্যে তাঁরা ভ্রাম্যমান গ্রন্থাগার, বিদ্যালয় ও কারখানার শ্রমিকদের জন্য নৈশ বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করেন । যদিও গোখলের মৃত্যুর পর এই সংস্থা কার্যত ভেঙে পড়ে। অস্তিত্ব থাকলেও বর্তমানে এই সংস্থার সদস্য সংখ্যা খুবই কম ।
রাজনৈতিক জীবনের প্রতিসময়ই সক্রিয় ছিলেন গোখলে । দেশীয় ও বৈদেশিক রাজনীতি সম্পর্কে জানার উদ্দেশেও বিশেষ কিছু কারণে একাধিক স্থান ভ্রমণ করেন । ১৯১২ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে যান তিনি । জানতে পারেন এক তরুণ ব্যারিস্টার, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী আফ্রিকায় ভারতীয়দের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধেআন্দোলনে নেমেছেন । সেখানেই প্রথম সাক্ষাত্ হয় গুরু-শিষ্যের ।গোখলের রাজনীতির আধ্যাত্মিকীকরণ, সমাজসংস্কার মূলক ভাবনা, শিক্ষা ও নির্দেশনায় অনুপ্রেরিত হয়েছিলেন মহাত্মা । বলাই বাহুল্য তিনিই গোখলের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী ।
১৯১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি মাত্র ঊনপঞ্চাশ বছর বয়সে তাঁর জীবনাবসান হয় । ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি সংস্কারের পক্ষে বরাবর থেকে গোখলে কেবলমাত্র ভারতের তরুণ প্রজন্মকে শিক্ষিতই করে তোলেননি, তাঁদের অতীতের তুলনায় অনেক বেশি সরকারি কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলেন । শিষ্য গান্ধীজি তাঁর পাশ্চাত্য রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও উদারতাবাদের আদর্শকে পরবর্তীকালে না মানলেও ১৯৫০ সালের ভারতীয় সংবিধানে যে ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের সরকার ব্যবস্থা গঠিত হয়, তা স্পষ্টতই গোখলের মতাদর্শের পরিস্ফুটন।