বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

রানী রাসমণি – বাংলার মহিয়সী সমাজ সংস্কারক 

February 19, 2021 | 3 min read

জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল “করুণাময়ী রানী রাসমণির” মাধ্যমে রানী রাসমণির নাম সকলেরই জানা। মহিয়সী এই নারী একদিকে যেমন ছিলেন একজন সমাজ সেবক ঠিক তেমনই অন্যদিকে তিনি ছিলেন একজন ঈশ্বরপ্রেমী মানুষও। বাংলার অন্যতম খ্যাতনামা মহিলা রাসমণি। সমাজ সংস্কারে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।

রানী রাসমণির জন্ম হয় ২৬ সেপ্টেম্বর ১৭৯৩ সালে, বর্তমান উত্তর ২৪ পরগণার হালিশহরে অবস্থিত কোণা নামক একটা ছোট্ট গ্রামে | তাঁর বাবার নাম ছিলো হরেকৃষ্ণ দাস আর মায়ের নাম ছিলো রামপ্রিয়া দাসী | জানা যায় হরেকৃষ্ণ দাস ছিলেন পেশায় একজন সাধারন দরিদ্র কৃষক ও গৃহনির্মাণকারী | ছোটবেলায় রাসমণির নাম তাঁর মা রামপ্রিয়া দাসীই প্রথম ভালোবেসে “রানী” রেখেছিলেন | পরে তাদের প্রতিবেশীদের দৌলতেই তাঁর নাম হয়ে যায় রানী রাসমণি |

রাসমণি অতি অল্প বয়সেই বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন | তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সেই কলকাতার যানবাজারের জমিদার রাজচন্দ্র দাসের সাথে বিয়ে করেন, সালটা ছিলো ১৮০৪ খ্রিষ্টাব্দ | শোনা যায়, বাবু রাজচন্দ্র দাস নাকি ব্যবসায়িক কাজের সুত্রে একদিন ত্রিবেণীতে যাচ্ছিলেন, যেতে যেতে তিনি হঠাৎই পাশের গঙ্গার ঘাটে এক ১১ বছর বয়সই মেয়েকে দেখতে পান, যে সেখানে স্নান করতে এসেছিলো |

তাঁর রূপ ও মুখের লাবন্য দেখে সদ্য যৌবন প্রাপ্ত যুবক রাজচন্দ্র তাঁর প্রেমে পরে যান | সেইদিন রাজচন্দ্র আর ত্রিবেণীর উদ্দেশ্যে যেতে পারেননি এবং পুণরায় বাড়ি ফিরে আসেন | এরপরেও তিনি আরো বেশ কিছুবার হালিশহরে, রাসমণির গ্রামে এসেছিলেন | সেখানে তিনি রাসমণির রূপ ও লাবন্য ছাড়াও তেজস্বীনী এবং দুয়ালু রূপের সাথেও পরিচিত হন | যারফলে তিনি রানীকে আরো গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেন |

অবশেষে রাজচন্দ্র দাস, তাঁর বাড়ির অনেক গুরুজনদের অমত থাকার পরেও রানীকে বিয়ে করে আনেন সেখানে | রাজচন্দ্র দাস ও রানী রাসমণির মোট ৫টা সন্তান হয়, যার মধ্যে তাদের প্রথম সন্তান জন্মের কিছু সময় পরেই মারা যায় | সে ছিলো তাদের প্রথম পুত্র সন্তান | তাদের বাকি ৪টে সন্তানই ছিলো মেয়ে | যাদের নাম যথাক্রমে- পদ্মামনি,কুমারি,করুণা এবং জগদম্বা রাখা হয় |

রানী রাসমণি ও রাজচন্দ্র দুজনেই ভীষন দয়ালু প্রকৃতির মানুষ ছিলেন | গরিব, দুঃখী, ভিক্ষুক কিংবা ক্ষুধার্ত মানুষ প্রত্যেকেরই রানী রাসমণি ও রাজচন্দ্র সেবা করে যেতেন মন প্রাণ উজার করে | কেউই অবহেলিত হতনা তাদের দয়া ও ভালোবাসা থেকে | রাসমণি ও তাঁর স্বামী পরিবারের বেশিরভাগ সম্পদ সামাজিক কর্মকান্ড, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানে ব্যয় করে দিতেন | এতে অবশ্য তাদের পরিবারের অনেকেই বিভিন্নভাবে অমত প্রকাশ করতেন কিন্তু তাতে তাঁরা দুজনে কোনোদিনই মানুষের সেবা বন্ধ করেননি |

জনসাধারণের জন্য স্নানঘাটের অসুবিধা দূর করতে তিনি বহু টাকা ব্যয় করে ফেলেন | তিনি ও তাঁর স্বামী রাজচন্দ্র, নিজের টাকায় কলকাতার বাবুঘাটকে বাঁধাতে সক্ষম হন | এরপর তারা তৈরী করেন আহিরীটোলা স্নানঘাট ও নিমতলা স্নানঘাটও | এছাড়া বাবু রোড নির্মান সহ নিমতলা শ্মশান ঘাটে নিজের পারিবারিক জমির উপর পাকা বাড়ি নির্মানও করেন তারা |

রাসমণির উদ্যোগে তৈরী সবচেয়ে বিখ্যাত নিদর্শন হলো দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দির | কিন্তু সেটা তৈরীর পেছনেও রাসমণিকে সমাজের উচ্চবর্ণের মানুষদের কাছ থেকে অনেক কথা শুনতে হয়েছিলো | যেহেতু রাসমণির পিতৃ পক্ষের পরিবার সেইসময়কার সমাজ ব্যবস্থা অনুযায়ী নিম্নবর্ণের ছিলো তাই সমস্ত ব্রাহ্মণ সমাজ দক্ষিণেশ্বরের কালী মন্দির নির্মানের কাজে প্রথমে বাঁধা সৃষ্টি করে | কিন্তু তাতে বিশেষ লাভ হয়নি, কারণ রাসমণি ব্রাহ্মণ সমাজের বাঁধা তোয়াক্কা না করে কালী মন্দির নির্মানের কাজ চালিয়ে যান | পরে, দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের নির্মান কাজ শেষ হলে সেই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসাবে শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসকে নিযুক্ত করা করা হয় |

১৮২০ সাল। বাংলায় তখন ভয়াবহ বন্যা | সেইসময় অনেক সাধারণ মানুষই বন্যার কবলে পরে নিজের বাড়ি-ঘর সহ সকল সম্পত্তি হারিয়েছিল | দয়াময়ী রানী রাসমণি প্রতিবারের মত সেইবারেও জনসাধারণের উদ্দেশ্যে প্রচুর টাকা ব্যয় করেন | জানা যায় সেই বছরেই রানী রাসমণির বাবা হরেকৃষ্ণ দাসও মারা যান | যেহেতু হরেকৃষ্ণের কোনো ছেলে সন্তান ছিলো না তাই সেহেতু  রাসমণিই, মেয়ের কর্তব্য অনুসারে বাবার পরলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য গঙ্গার ঘাটে যান |

রানী রাসমণি ও রাজচন্দ্র দাসের বৈবাহিক জীবন বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি | রাজচন্দ্র দাস মাত্র ৪৯ বছর বয়সে মারা যান |  স্বামীর এই মৃত্যুতে রাসমণি ভীষনভাবে ভেঙ্গে পরেন | শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মানুষটা যে এত কম বয়সে চলে যাবেন, তা তিনি কখনো ভাবতেও পারেননি | রাজচন্দ্র তাঁর স্ত্রীকে কোনদিনও জনহিতকর কাজ করার ক্ষেত্রে কোনোভাবেই বাঁধা দেননি | সর্বদাই তাঁকে উৎসাহ দেওয়ার পাশাপাশি, পাশেও থেকেছেন একজন বন্ধুর মতো |

অবশেষে ১৮৬১ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারী, প্রায় ৬৮ বছর বয়সে এই মহান মহিয়সী নারীর জীবনাবসান হয় |

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Rani Rashmoni

আরো দেখুন