বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

কস্তুরবা গান্ধী – ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অলিখিত ইতিহাস

February 22, 2021 | 3 min read

ভারতীয় রাজনীতিতে, জনমানসে গাঁধীর প্রভাব যত বেড়েছে, সময় এগিয়েছে, কস্তুর পরিণত হয়েছেন কস্তুরবা এবং পরিশেষে বা-তে। তাঁর নিজস্ব সত্তা লীন হয়ে গিয়েছে গাঁধীর সুবিশাল ব্যক্তিত্বের ছায়ায়। ১৮৯৭ থেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত তিন দশকের বেশি জুড়ে যিনি দক্ষিণ আফ্রিকার সত্যাগ্রহ আন্দোলন, ভারতে অসহযোগ ও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন, বহু বার কারাবরণ করেছেন, লিখেছেন জাতির প্রতি বার্তা, এমনকি বিপুল জনসভায় ভাষণ দিয়েছেন। ১৯৪২ সালে গাঁধী গ্রেফতার হওয়ার পর, তাঁকে গাঁধী জীবনীকাররা সুশীল শান্ত পতির অনুগমনকারিণী ‘বা’তে পরিণত করে রেখেছেন। সুবিচার কি গাঁধীও করেছেন? তাঁর নিজের লেখায় যতটা এসেছে নিজের সিদ্ধান্ত, অনুশোচনা, নিজের মনোভাবের বিশ্লেষণ, ততটাই উহ্য থেকেছে কস্তুরবার মনের কথাগুলি।

কেমন ছিল কস্তুরবার ভাবনা? কী ভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে বোঝাপড়া করেছেন তিনি? সাত বছর বয়সে বিবাহ। ১৫ বছরে প্রথম বার মা হওয়া। সদ্যোজাত সন্তানের মৃত্যুশোক। তখনও কস্তুরবার বাইরের জগৎ ছিল না। স্কুলপড়ুয়া স্বামীর সত্য নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা আর কামনাবাসনার উচ্ছ্বাস, তার সঙ্গে নানা সন্দেহে বিপর্যস্ত মন। স্বামীর বিরহ ছিল জীবনের অবশ্যম্ভাবী অঙ্গ। দেশান্তরি হলে কবে ফিরবেন জানা নেই। অহিংসার সঙ্গে আলিঙ্গন করেছেন স্বেচ্ছাদারিদ্রকে। ডারবান যাত্রায় জাহাজে পুরোটা সময় গাঁধী স্ত্রীপুত্রদের ইউরোপীয় কেতা, চলনবলন শেখালেন। 

শেষে বর্ণবিদ্বেষী জনতার হিংস্র আক্রমণের ভয়ে জাহাজ আটকানো হল। তাও শেষ রক্ষা হল না, পথে আক্রান্ত হলেন গাঁধী। বন্ধুর বাড়ি স্ত্রীপুত্র-সহ আশ্রয় নিলেন, ঘিরে থাকল জনতা। জোহানেসবার্গের বড় বাড়িতে সবে গুছিয়ে বসেছেন, ভারতীয়দের কলোনিতে হানা দিল বিউবোনিক প্লেগের মহামারি। গাঁধী কিছু বলার আগেই কস্তুরবা যেতে চাইলেন প্লেগ-আক্রান্তদের কাছে, সেবার জন্য। গাঁধী স্ত্রীকে বুঝিয়েসুজিয়ে পাঠান, ভারতীয় পরিবারগুলির কাছে গিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা, স্বাস্থ্য সচেতনতার কথা বোঝাতে। 

সেই প্রথম কস্তুরবার অন্য পরিমণ্ডলে প্রবেশ। যেন এক নতুন মানুষ। পতি-অনুগামিনী নন, নিজের বিশ্বাসের শক্তিতেই কস্তুরবার জনসেবায় প্রথম অংশগ্রহণ।

অল্প বয়সে চেয়েছিলেন নিজের ঘর, একার সংসার— যেখানে অন্য বর্ষীয়সীরা নন, সিদ্ধান্ত নেবেন কস্তুর নিজে। সে ঘরের রূপ বদলেছে অকল্পনীয় বৈচিত্রে। দক্ষিণ আফ্রিকার ফিনিক্স সেট্লমেন্টে একটি সংবাদপত্রকে চালিয়ে যাওয়ার লড়াই জারি রাখতে গাঁধী গড়ে তুললেন এক বসত। স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে এবড়োখেবড়ো খেতের জমি পেরিয়ে দুই মাইল হাঁটা। কস্তুরের স্বপ্নের বাড়ি স্থানান্তরিত হল সেখানেই, সামূহিক জীবনযাপনে। 

১৯১৩ সালে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিল, খ্রিস্টান ধর্ম ছাড়া অন্য মতে সম্পাদিত বিবাহ দক্ষিণ আফ্রিকায় বেআইনি। তার ফলে বহু ভারতীয় স্ত্রীকে ফিরে যেতে হবে দেশে, সন্তানরা হয়ে যাবে অবৈধ, তাদের সম্পত্তিতে অধিকার থাকবে না। স্থানীয় ভারতীয় সম্প্রদায়ের জন্য বিরাট আঘাত। নাটালের ফিনিক্স বসত থেকে গাঁধী সূচনা করলেন সত্যাগ্রহের। কারাবরণ করার প্রস্তাব দিলেন গাঁধী, কিন্তু মনস্থির করেছিলেন কস্তুরবা নিজেই— বাল্যস্মৃতি থেকে সীতা, রানি লক্ষ্মীবাই প্রমুখের কাহিনি মনের মধ্যে মন্থন করে। 

স্বামীর আদেশে নয়, নিজের লড়াই বলে দেখেছিলেন বলেই, সঙ্গিনীদের নিয়ে ট্রেনে ট্রান্সভাল এসে কারাবরণ করতে তাঁর বাধেনি। মারিত্সবুর্গ জেলে অনেক কষ্ট, খাবারের অভাব, রক্ষীদের উৎপীড়ন, সব সহ্য করে ভাঙা স্বাস্থ্য নিয়ে জেল থেকে বেরোলেন তিন মাস পর। সন্তরমণী হতে চাননি, দোষেগুণে এক স্বাভাবিক নারী হতে চেয়েছিলেন, ফলে নিজের জীবনের সঙ্কটগুলির মোকাবিলা তাঁকে নিজেকেই করে নিতে হয়েছে।

১৯২০ সালের অসহযোগ আন্দোলনে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েছিলেন কস্তুর। তত দিনে তিনি বুঝে গিয়েছেন, নানা ভাবে আন্দোলনের অভিমুখ বদলালেও স্বরাজই একমাত্র লক্ষ্য। বিদেশি পণ্যবর্জন আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বলে মহিলারা এসেছিলেন আন্দোলনের পুরোভাগে। ১৯২২ সালে রাওলাট আইনের বিরোধিতার পর গাঁধীর প্রহসনসদৃশ বিচার হয়, ছয় বছরের কারাবাসও হয়। সেই সময় অবিচলিত (সম্ভবত অন্তরে বিধ্বস্ত) কস্তুরবা লিখেছিলেন জাতির প্রতি তাঁর আবেদন। 

১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের আরম্ভে গ্রেফতার হন গাঁধী। দেশব্যাপী নিষ্পেষণে নির্বিচারে জেলবন্দি মানুষ। শিবাজি পার্কে গাঁধীর ভাষণ দেওয়ার কথা সে দিন বিকেলে— শ্রোতারা এসেছেন, বক্তা কই? কস্তুর বললেন, আমি করব সম্ভাষণ। সুশীলা নায়ারের সঙ্গে বসে লিখে ফেললেন সেই অমোঘ ভাষণ। “গাঁধীর আদর্শ অনুসরণ ছাড়া আমাদের অন্য পথ নেই। ভারতের মেয়েরা তাঁদের শক্তির পরিচয় দিন। তাঁরা সবাই আন্দোলনে যোগ দিন, জাতিবর্ণের বিভেদ ভুলে। সত্য ও অহিংসাই হোক আমাদের মন্ত্র।” 

১৯৪৪-এ আগা খান প্রাসাদে অন্তরিন অবস্থায় মৃত্যু হয় কস্তুরবার। সারা দেশ শোকাচ্ছন্ন, কিন্তু সরকার মানুষকে ভিতরে এসে শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের অনুমতি দেয়নি। গাঁধী তাঁর সন্তানদেরও ভিতরে আসতে দিলেন না, যাতে দেশবাসীর চেয়ে এক তিল বেশি সুবিধে যেন তাঁরা শোকপালনেও না পান। নির্জনে, কারাগার প্রাঙ্গণে সৎকার হল অন্তরে-বাইরে সংগ্রামে লিপ্ত এক নারীর। ১৯৪৪ সালে শোকে উদ্বেল দেশ তাঁকে অভিধা দিল ‘জাতির মাতা’র।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#kasturbagandhi, #freedom movement

আরো দেখুন