বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

পাহাড়ও যেন গল্প বলে যেত শিশু লীলাকে

February 26, 2021 | 2 min read

যে বাঙালির ছোটবেলায় লীলা মজুমদার নেই, সে বাঙালির কোনও ছেলেবেলাই নেই। লীলা মজুমদার নামটির সঙ্গে শিশু সাহিত্যের বিষয়টি এমন ভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে, তাঁর লেখা ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’, ‘টংলিং’, ‘হলদে পাখির পালক’, ‘গুপীর গুপ্তখাতা’, ‘মাকু’ বাঙালি আজও ভুলতে পারে না। বাঙালির ছেলেবেলাকে তিনি তাঁর সাহিত্য দিয়ে জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে গেঁথে দিয়েছেন। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শিশু সাহিত্যিক যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে লীলা মজুমদারের নাম একই সঙ্গে উচ্চারিত হওয়া উচিত।

তাঁর ‘বদ্যিনাথের বড়ি’ গল্পে আশ্চর্য এক বড়ির অলৌকিক ক্ষমতার কথা বড় হয়েও আমাদের মনে থেকে যায়। কালুর বন্ধু বদ্যিনাথ কতকগুলো সাদা বড়ি এনে যখন বলে, ‘ওগুলো নাকি ছানা বাঁদরের রস দিয়ে তৈরি’, যেহেতু মানুষদের পূর্বপুরুষ বাঁদর ছিল এবং বাঁদরের রক্ত মানুষের রক্তে এখনও মিশে ‘আছেই আছে’, তাই সেই আশ্চর্য বড়ি খেলে তাদের আবার বাঁদর হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, ‘ওই একরকম ধাত কিনা’, অবিশ্বাস হয় না। অতএব রোজ পড়াতে আসা মাস্টারের হাত থেকে বাঁচতে এর প্রয়োগ কালুর কাছে বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছিল। সেই বড়ি দেওয়া পান খেয়ে অবশ্য মাস্টারের কিছু হয়েছিল কি না, কালু আর জানতে পারেনি। তিনি অন্য গ্রামের স্কুলে বদলি হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু কালু রাতের অন্ধকারে পাঁচিল থেকে দুটো ল্যাজ ঝুলে থাকতে দেখত।

লীলা মজুমদারের এই দুর্লভ ‘বাল্যদৃষ্টি’র কথা উল্লেখ করে গিয়েছেন রাজশেখর বসু থেকে আরও অনেকেই। এই দৃষ্টির জন্ম হয়েছিল তাঁর শৈশবে, খাসিয়া পাহাড়ের শিলং শহরে। সেখানকার পরিবেশ তাঁকে সহায়তা করেছিল। আরও একটি কারণ অবশ্যই ছিল, সেটি পারিবারিক। বাংলাদেশের শিল্প, সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে যে ক’টি পরিবারের অবদান উল্লেখযোগ্য, তাদের মধ্যে রায়চৌধুরী পরিবার অন্যতম। 

লীলা মজুমদারের সাহিত্যে যে বাল্যদৃষ্টি, তার সূচনা হয়েছিল উপেন্দ্রকিশোরের ‘সন্দেশ’-এর হাত ধরে। সদ্য ছাপা ‘সন্দেশ’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাটি তিনি উপেন্দ্রকিশোরের হাতেই দেখেছিলেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। সেই স্মৃতি তিনি কোনও দিনও ভুলতে পারেননি। ১২ বছর বয়সে শিলং থেকে কলকাতায় আসার পর সুকুমার রায় তাঁকে দিয়ে জীবনের প্রথম গল্প ‘লক্ষ্মীছেলে’ লিখিয়ে নিয়েছিলেন ‘সন্দেশ’-এর জন্য। বড়দা সুকুমার, বড়দি সুখলতা, মেজদি পুণ্যলতা, মণিদা সুবিনয়ের মতো মানু্ষের প্রভাব ক্রমশ তাঁকে যথার্থ ‘সন্দেশী’ করে তুলেছিল। 

তিনি নিজেই লিখেছেন, ‘জ্যাঠামশাইরা, জ্যাঠামশাইয়ের ছেলেমেয়েরা সবাই গল্প লিখতেন, চমৎকার ছবি আঁকতেন। সুখলতাদির পরিদের গল্প পড়ে মুগ্ধ হতাম। ছোটো জ্যাঠা কুলদারঞ্জনের রবিনহুড পড়ে তো প্রায় অজ্ঞান!’

খুব ছোট থেকেই স্কুলের ‘প্রসূন’ পত্রিকায় হাত পাকানোর পালা শুরু হয়েছিল। বাড়িতে বানিয়ে বানিয়ে এমন করে ঘটনার বর্ণনা দিতেন, শুনে মনে হত বুঝি সত্যিই ঘটেছে। তাই নিয়ে মায়ের বকুনিও খেয়েছেন কত বার। কিন্তু বানানো গল্প আর মিথ্যে কথার মধ্যে পার্থক্যটা বুঝতে চেষ্টা করতেন। লিখেছেন, ‘শিলং পাহাড়ে থাকতাম, সরল বনের মধ্যে হাওয়া দিলে সোঁ সোঁ শব্দ হত। ঠিক যেন লুকনো কথা বলে দিচ্ছে। দুটো পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে ঝোড়ো হাওয়া বইলে গোঁ গোঁ শব্দ হত। মনে হত ওইখানে কোনও গোপন জায়গায় শেকল দিয়ে দৈত্য বাঁধা আছে, ছাড়াবার চেষ্টা করছে। পাহাড়ি আয়ারাও গল্প বলত। সে সব দুঃখের গল্প, হারানোর গল্প, না পাওয়ার গল্প, কষ্টের গল্প। শুনে কান্না পেত।’

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Leela Majumder

আরো দেখুন