মহিলা ভোটই শক্তি , প্রত্যয়ী চন্দ্রিমা
‘টানা একমাস প্রচার। দু’টো পুরসভা মিলিয়ে ৫৪টা ওয়ার্ড ঘোরা। রোদের ছাপ পড়বে না? তাও এই ৬৬-তেও আমার সুগার, প্রেশার কিছছু নেই। ওষুধ বলতে হালকা ডোজের একটা ঘুমের ওষুধ। ব্যস।’
বিরাটি মোড় থেকে ভিতরে অন্তত পাঁচ কিমি রাস্তা পেরলে পড়বে কালচার মোড়। ৮০০ মিটার দূরে পুবপাড়া। দু’টো বিধানসভা কেন্দ্রের সংযোগস্থল। উত্তর দমদমের শেষ প্রান্ত। ঢিল ছোড়া দূরে শুরু কামারহাটি।
তিনটের চড়া রোদে র্যালি শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু লোক কোথায়? সাদা স্করপিওর সামনে চেয়ার পেতে বসলেন চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য (Chandrima Bhattacharya)। মন্ত্রিসভার প্রায় হাফ ডজন দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী। বয়স সত্তরের দিকে ছুটছে কে বলবে! তাও মুখেচোখে টানা ঘোরাঘুরির ছাপ স্পষ্ট। ছেলে ও হাতেগোনা কয়েকজন পার্ষদ আশপাশে। কিছুক্ষণ বাদে গাড়ি থেকে নামলেন সৌগত রায়। বললেন, ‘কী গো চন্দ্রিমা, রোদ্দুরে এত তামাটে হলে কী করে?’
মন্ত্রীর উত্তর, ‘টানা এক মাস প্রচার … সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ছি। দুপুরে দু’ঘণ্টা বাদ দিলে ফের রাত ১০-১১টায় বাড়ি ফেরা রুটিন হয়ে গিয়েছে। তামাটে হব না! তাও বলব, হাঁটাহাটি করে ভালোই আছি।’
ঘড়ির কাঁটা আরও মিনিট পনেরো ঘুরেছে। সিনেমার ফাস্ট ফরওয়ার্ডের মতো কর্মী-সমর্থকদের ভিড় বাড়তে শুরু করল। এলেন ছৌনাচের শিল্পীরা। এল সবুজ বেলুনে সাজানো জিপ। এল হলুদ শাড়ি পরা মহিলাদের দল। আধ ঘণ্টার মধ্যে জমাট ভিড়ে পরিস্থিতি এমনই, এমবি রোডে যান সামাল দিতে নেমে পড়লেন তৃণমূলের সমর্থকরাই। ৪টের সময় যখন বিরাটি মোড় পর্যন্ত র্যালি শুরু ‘হবে হবে’ করছে। ভিড় দু’দিকে প্রায় চওড়া হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।
তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অত্যন্ত স্নেহভাজন। অন্যদিকে ‘দিদি’র প্রতি নিজের আস্থা প্রদর্শনে যে ক’জন নেতানেত্রী ১০০-তে ২০০ পাবেন, তাঁদের অন্যতম চন্দ্রিমা দেবী। ভুলক্রমেও তাঁকে দিয়ে কেউ বলাতে পারবেন না, ‘আমি করেছি’। উত্তর আসবেই আসবে, ‘দিদি করেছেন। যা চেয়েছেন, আমি পালন করেছি মাত্র’। কিন্তু উত্তর দমদমের আনাচে কানাচে কান পাতলেই যে শোনা যাচ্ছে, লড়াই যথেষ্ট ‘টাফ’ বিদায়ী স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রীর জন্য।
শুরু হল টানটান প্রশ্নোত্তর পর্ব। পাশে বসে থাকা পোড়খাওয়া এমপি সৌগতবাবুও যোগ দিলেন মাঝেমাঝে।
—‘হারলেন কেন ২০১৬-তে?’
—‘যা গেছে তা যাক।’
—‘অনেকে বলছেন যে বিধান বিশ্বাসের জন্য?’
—‘না না, এগুলি বাজে কথা। বিধান এবারও আমার চিফ ইলেকশন এজেন্ট।’
পাশ থেকে সৌগতবাবু বলে উঠলেন, ‘সত্যিই চন্দ্রিমা কেন যে ২০১৬-তে হেরেছিল, আমিও বুঝতে পারিনি। না, না, বিধান ওইসব করবে না।’
—কাটা ঘাড়ে নুনের ছিটে দিতে তন্ময় ভট্টাচার্যের পোস্টার দেখেছেন সর্বত্র, ‘আবার তন্ময়’? তাছাড়া উত্তর দমদম বামেদের পুরানো শক্ত ঘাঁটি সেই কবে থেকে।
—২০১১ সালের মার্জিন মনে আছে আপনার? ১৯ হাজার। এবার তার বেশি ভোটে জিতব।’ প্রত্যয়ী উত্তর চন্দ্রিমা দেবীর।
কথা বলছেন আর চলছে ছবি তোলা। জমাট ভিড়ের অর্ধেকেরও বেশি বিভিন্ন বয়সি মহিলা। শুধু নিজেরাই আসেননি, বাড়ির অন্য মেয়েদেরও নিয়ে এসেছেন। প্রত্যেকের মাথায় টুপি ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’। এই মহিলামহলই ক্যামেরায় বারবার তৃণমূল প্রার্থীকে ধরতে চাইছেন। চলে এলেন স্বঘোষিত ‘ভবিষ্যৎদ্রষ্টা’ এক সমর্থক। বললেন, ‘দেখবেন আপনি ঠিক ১১ হাজার ভোটে জিতবেন। তার একটাও কম নয়, একটাও বেশি নয়।’ ‘আবার তুই এসেছিস! কেন দিদিকে বিরক্ত করছিস?’ পাশ থেকে ঝাঁঝিয়ে উঠল এক সমর্থক।
—‘বিজেপিও চেষ্টার কসুর করছে না। আপনাদের ‘বাংলার মেয়ে’ প্রচারের পাল্টা ‘বাংলার মা’ শোভা মজুমদারের ঘটনা ট্যুইট করেছেন প্রধানমন্ত্রী নিজে। নাড্ডা র্যালি করে গিয়েছেন।’
—‘ওই র্যালি দেখেছেন? এক কিমিও গিয়েছিলেন কি না সন্দেহ। ভিড়ের নামগন্ধ নেই। আর ওইসব দেখেই তো পরদিন অমিত শাহের মিছিল বাতিল হল। আর শোভা মজুমদারের ঘটনা নিয়ে তো সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়বে তো বিজেপিই।’ উত্তর চন্দ্রিমার।
—‘আরে, ওই মহিলা কিডনির অসুখে ভুগছিলেন। তাই মুখচোখ ফুলে লাল হয়ে গিয়েছিল।’ উত্তর দিলেন সৌগত।
—‘কিন্তু, পাল্টা প্রচারও তো তেমন নেই আপনাদের?’
—‘বলছি তো? বিজেপি প্রার্থী নিজের প্রার্থী প্যাডে ওই মহিলার ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করেছেন। ময়নাতদন্তও করতে বলেননি।’
স্বাস্থ্যসাথী কার্ড যে মহিলাদের নামেই হবে, সেই পরিকল্পনার অন্যতম রূপকার বিদায়ী স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী। এক্ষেত্রেও তৃণমূল মহিলা কংগ্রেসের সভানেত্রী একটি বারের জন্যও মুখ ফুটে বলেন না।
—‘কেন বলব? বলবেন মমতাদি, যিনি সবার কথা ভাবেন। বলবেন আমার এইসব মেয়েরা। বলে মহিলা মুখের ভিড়ের দিকে দেখালেন। মনে রাখবেন, এই বিধানসভায় মহিলা ভোটারের সংখ্যা পুরুষদের থেকেও বেশি। আর মেয়েরা এবার কাকে চায় যেন?’
সমস্বরে উত্তর এল, ‘দিদিকে।’
পেলেন তো উত্তর। রোদের তাত তখন সরাসরি মুখে পড়ছে আত্মপ্রত্যয়ী নেত্রীর।