ভবানীপুরে বক্সার বনাম অভিনেতার লড়াই
একুশের ভোটযুদ্ধে রাজনীতির আতস কাচের তলায় একদিকে যদি থাকে নন্দীগ্রাম, অন্যদিকে ভবানীপুর। নন্দীগ্রামের (Nandigram) ভোট পর্ব ইতিমধ্যে মিটে গিয়েছে। এবার ২৬ এপ্রিল ভবানীপুরের দিকে নজর বাংলার রাজনৈতিক মহলের। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) ছেড়ে যাওয়া ভবানীপুর আসনই এখন ভোট পর্বের শেষদিকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। নন্দীগ্রামে প্রার্থী হওয়ার মধ্যে দিয়ে আগেই মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যাতে বেশ খানিকটা চাপে পড়ে যায় গেরুয়া শিবির। এমনকী ১৮ জানুয়ারি পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রাম তেখালির জনসভা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, ‘ভবানীপুর আমার বড় বোন’। এবার সেই ভবানীপুরকে কেন্দ্র করেই রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশ আবর্তিত হচ্ছে।
২০১১ ও ২০১৬ সালের নির্বাচনে ভবানীপুর কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শেষ বিধানসভা নির্বাচনে সিপিএম ও কংগ্রেসের জোটের প্রার্থী দীপা দাশমুন্সিকে ২৫ হাজারের বেশি ভোটে পরাজিত করেছিলেন তৃণমূল নেত্রী। ২০২১ সালের নির্বাচনে এই কেন্দ্রে এবার মমতা প্রার্থী করেছেন তাঁর দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী ও বর্ষীয়ান নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়কে। শোভনদেববাবুর বাড়ি এই কেন্দ্রের মধ্যে। ভূমিপুত্র তিনি। ফলে তৃণমূল (Trinamool) নেতৃত্ব বলছেন, ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়। আর ভবানীপুর নিজের ছেলেকেই চায়’।
এই কেন্দ্রে মূল লড়াই তৃণমূল বনাম বিজেপির। আরও একটু স্পষ্ট করে বললে বক্সার শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের (Shobhandev Chattopadhyay) সঙ্গে লড়াই হচ্ছে অভিনেতা রুদ্রনীল ঘোষের (Rudranil Ghosh)। রাজনৈতিক জীবনে উত্তরণ ঘটার আগে এলাকায় শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় পরিচিত ছিলেন বক্সার হিসেবে। খেলেছেন দেশ-বিদেশের একাধিক টুর্নামেন্ট। ঝুলিতে এসেছে একাধিক পুরস্কার। হেরেছেন মাত্র দু’বার। আর রাজনীতির ময়দানে সাতবার বিধানসভায় লড়েছেন, জিতেছেন প্রত্যেকবার। এবারের ভোটযুদ্ধে যখন ‘খেলা হবে’ স্লোগান উঠেছে, তখন অরফানগঞ্জে প্রচারের ফাঁকে বললেন, ‘আমি খেলোয়াড়। লড়াইতে নেমেছি জিতব বলেই।’ করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন, সুস্থ হয়েছেন। কিন্তু ৭৭ বছরের এই যোদ্ধা এখনও নিয়ম করে প্রতিদিন দুবেলা জনসংযোগ করেন। শোভনদেববাবু কথায়, ‘বক্সার, পুরোহিত, রাজনীতিবিদ—এভাবেই মানুষ আমাকে এত বছর ধরে দেখে এসেছেন। এখানে জন্মেছি। আমাদের পরিবার দুশো বছরের বাসিন্দা। ফলে ভবানীপুরের সঙ্গে হৃদয়ের সম্পর্ক।’
বিরোধী প্রার্থী রুদ্রনীল ঘোষের অভিনয় দেখেছেন শোভনদেববাবু। আবার শোভনদেবের বক্সিংয়ের পারদর্শিতা সম্পর্কে জানেন বিজেপি প্রার্থী। কেদার বোস লেনে প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে রুদ্রনীল বললেন, ‘শোভনদেববাবু ভালো মানুষ। তাঁর বক্সিংয়ের পাঞ্চের কাছে আমি পেরে উঠব না। কিন্তু আমি রাজনীতি ও থিয়েটারের মঞ্চ থেকে উঠে আসা। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছোটবেলা থেকেই। আর ভবানীপুরের লড়াইয়ে আমি এবং তৃণমূল প্রার্থী দু’জনই নতুন।’ লড়াইয়ের ময়দানে তিনি যে রয়েছেন, এটাই জানান দেওয়ার চেষ্টা করলেন বিজেপি প্রার্থী। তবে এলাকার মানুষ বলছেন, বিজেপি প্রার্থী এতবার দলবদল করেছেন যে ‘দলবদলু’ তকমাও ছোট হয়ে গিয়েছে। আর ‘দাদা, আমি সাতে পাঁচে থাকি না’ — রুদ্রনীলের কণ্ঠে উচ্চারিত এই লাইনটা নিয়েও বিজেপি প্রার্থীকে বিঁধতে কসুর করেনি তৃণমূল।
ভবানীপুরের এই লড়াইতে আছেন সংযুক্ত মোর্চার তরফে কংগ্রেস প্রার্থী সাদাব খান। তাঁর হয়ে প্রচারে নামতে কিন্তু দেখা যায়নি গতবারের প্রার্থী দীপা দাশমুন্সিকে। যদিও সাদাব মনে করেন, প্রচারে গিয়ে মানুষের ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন। বিশ্বাস আছে, আশীর্বাদ পাবেন ভোট বাক্সে। অনেকেই বলে থাকেন ভবানীপুর হল, ‘মিনি ভারতবর্ষ’। সব ধর্ম, সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। তাঁরা সকলেই তৃণমূলের প্রতি আস্থা রাখবেন বলে বিশ্বাস জোড়াফুল শিবিরের। অন্যদিকে গেরুয়া শিবিরের দাবি, লোকসভার ফলাফলে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এখানেও পদ্ম ফুটবে।
এই বিধানসভায় আটটি ওয়ার্ড আছে। লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে ৬টি ওয়ার্ডে তৃণমূলের ভালো ফল হয়নি। ৭৭, ৮২ নম্বর ওয়ার্ডে ভালো ফল করে তৃণমূল। কিন্তু ৬৩, ৭০, ৭১, ৭২, ৭৩, ৭৪ নম্বর ওয়ার্ডে আশানুরূপ ফল হয়নি তৃণমূলের। তবে সামগ্রিকভাবে এই বিধানসভায় ৩৫০০ ভোটে এগিয়ে ছিল জোড়াফুল। যদুবাবুর বাজারে সওদা সারতে আসা এলাকার লোকজনরা বলছেন, ভোটের প্রচারের সময় বিজেপি নেতাদের দেখা যাচ্ছে। কিন্তু উম-পুনের সময় কোথায় ছিলেন তারা? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা, ১০ বছরের উন্নয়ন, শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের ব্যক্তি ইমেজ, দক্ষিণ কলকাতায় তৃণমূলের সংগঠন—মানুষের নজরে এসেছে।
রাজনীতির অনেক ইতিহাসের সাক্ষী রয়েছে এই বিধানসভার অন্তর্গত হাজরা মোড়। প্রায় প্রতিদিনই এই হাজরা মোড় থেকে শহর কলকাতা শুনতে পায় স্লোগান, প্রতিশ্রুতি, বাস্তবায়ন, অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ। ২ মে তারিখে হাজরা মোড় কি সবুজ আবিরে রাঙায়িত হবে? তার উত্তরের অপেক্ষায় গোটা বাংলা!