হ্যাটট্রিকের হাতছানি ‘কাজের ছেলে’ ফিরহাদ হাকিমের সামনে
‘সিন্ডিকেট-তোলাবাজি শেষ হওয়ার দরকার আছে, বুঝলে ভায়া!’ চা আর ‘বোম’-এর ফাঁক গলেই প্রবীণদের আড্ডায় ঢুকে পড়ল রাজনীতি। দুয়ারে কড়া নাড়ছে ভোট! তার আগে খিদিরপুরের (Khidirpur) রামকমল স্ট্রিটে বিখ্যাত দীপালি কেবিনের আড্ডায় একটু উত্তেজিত দেখাচ্ছিল বছর ষাটের অমিয় সাহাকে। উল্টোদিকে বসা সরল ভট্টাচার্য কিন্তু নিরুত্তাপ। সরাসরি বললেন, ‘আরে বিজেপি এলে এই ধান্দাবাজ লোকগুলোই তো ওদিকে যাবে। তার চেয়ে এই ভালো। হাজার হোক ববিকেই তো দরকারে পাওয়া যায়।’ কথাটা যে কতটা সত্যি, বেশ টের পাওয়া গেল খিদিরপুর-একবালপুর-বাবুবাজার ঘুরে। রাস্তা, আলো, ফ্লাইওভার—এক কথায় এলাকার চেহারা বেশ বদলে দিয়েছেন বিধায়ক ফিরহাদ হাকিম। হবে নাই বা কেন, তিনি যে পুরমন্ত্রী! এলাকার মানুষের সঙ্গেও তাঁর নিবিড় যোগাযোগ।
কলকাতা বন্দর (Kolkata Port)। ২০১১ সালে ডিলিমিটেশনের আগে পর্যন্ত এই বিধানসভা আসনটির অস্তিত্ব ছিল না। ছিল তিনটি কেন্দ্র—কবিতীর্থ, গার্ডেনরিচ ও আলিপুর। কংগ্রেসের খাসতালুক। সেই দিন আর নেই। কলকাতা পুরসভার ৭৫, ৭৬, ৭৮, ৭৯, ৮০, ১৩৩, ১৩৪, ১৩৫ ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এই কলকাতা বন্দর প্রথম থেকেই তৃণমূলের। টানা দু’বার এখানকার বিধায়ক ফিরহাদ (Firhad Hakim)। যদিও সে নাম ঢাকা পড়ে গিয়েছে ‘ববি’ ডাকের আড়ালে। এবার হ্যাটট্রিকের সুযোগ। ‘কাজের ছেলে’, ‘কাছের ছেলে’ এই পরিচয় নিশ্চিন্ত রেখেছে তাঁকে। গত বিধানসভা ও লোকসভা ভোটের অঙ্ক সেদিকেই ইঙ্গিত করছে।
বন্দর লাগোয়া এলাকা। বন্দরের সেই দিন আর নেই। তার প্রভাব চোখে পড়ে সমাজে। রামনগর থেকে ওঠা বিশাল গার্ডেনরিচ ফ্লাইওভারের দু’পারে আর্থ-সামাজিক অবস্থায় এক বৈপরীত্য চোখে পড়ে। একদিকে, পুরনো অভিজাত পাড়া, অন্যদিকে ঘিঞ্জি বস্তি, কারখানা। সংখ্যালঘু প্রধান এলাকা হলেও এখানে রয়েছে ভূকৈলাসের শিবমন্দির। এই বৈপরীত্য এখানকার মূল ইউএসপি। আর প্রধান সমস্যা আইন-শৃঙ্খলা। ফিরহাদ বিধায়ক হওয়ার পর থেকে সেই সমস্যা তেমন আর নেই। বরং নজর ঘুরেছে উন্নয়নের দিকে। ফিরহাদের বিধানসভায় প্রবেশ অবশ্য এই কেন্দ্র দিয়ে নয়। ২০০৯ সালে আলিপুর থেকে উপনির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। ততদিনে কাউন্সিলার হিসেবে কাজের সুবাদে বেশ নামডাক তাঁর। রাজ্যে পরিবর্তনের পর শুরু হয়েছিল স্বপ্নের উত্থান। তবে, সেটাও কাজকে সামনে রেখেই। সারা বছর কাজ, আর জনসংযোগ থাকায় জয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ফিরহাদ।
শেষ বিধানসভা নির্বাচনে প্রায় সাড়ে ৭৩ হাজার ভোট পেয়েছিল তৃণমূল। গত লোকসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে এই কেন্দ্রে রাজ্যের শাসকদলের ভোট বেড়ে হয়েছে ৮২ হাজারেরও বেশি। শতকরা হিসেবে দেখলে প্রায় ৫৭ শতাংশ ভোট ফিরহাদের দিকে। গত বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসের হয়ে লড়ে দ্বিতীয় স্থানে ছিলেন রাকেশ সিং। তিনি আবার গত লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপিতে যোগ দেন। ফলে সেবার গেরুয়া শিবির প্রায় ৪৬ হাজারের কাছাকাছি ভোট পায়। সেই রাকেশকে ভোটের আগে মাদক মামলায় গ্রেপ্তার করেছে পুলিস। তিনি নেই, তার উপর অঙ্কের ব্যবধান স্পষ্ট বলে দিচ্ছে এখানে বিজেপির জয় অসম্ভব। এখানে লড়াইতে রয়েছেন বন্দরের রাজনীতির আরেক পরিচিত মুখ মোক্তার। সংযুক্ত মোর্চা সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীর অবশ্য অভিযোগ, এলাকায় মন্ত্রী কোনও কাজই করেননি। রোজগার নেই। তার উপর তৃণমূল-বিজেপি ধর্মের নামে রাজনীতি করছে। আমরাই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ। তাই এলাকার উন্নয়নের জন্য মানুষ আমাদেরই ভোট দেবেন। বিজেপি প্রার্থী অবধকিশোর গুপ্ত অবশ্য এত কিছু সত্ত্বেও আশাবাদী শুধু বিভাজনের ভরসায়। পাকা ব্যবসায়ীর মেজাজে বলছেন, সংখ্যালঘু ভোট ভাগ হবে। আর হিন্দু ভোট একজোট। শাসকদলের গা জোয়ারি ওদের কাল ডেকে আনবে। ‘মিনি পাকিস্তান’ কটাক্ষও করলেন তিনি। তবে যে যাই বলুন না কেন, বন্দরে ববিই এগিয়ে।