জয়ের ধারা বজায় রাখাই লক্ষ্য সুব্রতর
প্রিয়-সোমেন-সুব্রত। ছয়ের দশকে উত্তাল রাজনীতির তিন দামাল ছেলে। এই জুটিকে তখন বলা হতো ‘কংগ্রেসের ত্রিফলা’! জেলা থেকে কলকাতায় পড়তে এসেছিলেন প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সি ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়। সোমেন মিত্র তখন উত্তর কলকাতা কংগ্রেসের দাপুটে যুবনেতা। ছাত্র-রাজনীতির সূত্রে ছোড়দা’র সঙ্গে আলাপ। অল্প কয়েকদিনেই তাঁর কক্ষপথে ঢুকে পড়া প্রিয়-সুব্রত’র। তার পরের ঘটনপ্রবাহ প্রায় সকলেরই জানা। ‘ত্রয়ী’র হাতে তৈরি হল বঙ্গ-রাজনীতির একটা উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। গোটা সত্তর দশকজুড়ে এই জুটিই ছিল সবচেয়ে বেশি চর্চার কেন্দ্রে। প্রিয়-সোমেন এখন আর নেই। ‘ত্রিফলা’র একফলা এখনও বুক ঠুকে লড়ছেন রাজনীতির ময়দানে। ‘ব্যাটিং’ও করছেন সেই ছয়ের দশকের মেজাজে! যেন আন্দোলনকারী সেদিনের ‘ছাত্রনেতা’ সুব্রত! তাঁর লক্ষ্য এখন একটাই—ছক্কা হাঁকিয়ে পরিষদীয় জীবনে হাফ সেঞ্চুরি পার করা। আর পারলেই জাতীয় রাজনীতির ‘রেকর্ড-বুক’-এ জ্বল জ্বল করবে সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের (Subrata Mukherjee) নাম। তাই এবারের একুশের ভোট তাঁর বর্ণময় রাজনৈতিক জীবন-পথে অনেকগুলি বাঁকের মধ্যে অন্যতম একটি।
পরিষদীয় রাজনীতিতে প্রথম বাঁকটি আসে ১৯৭১ সালে। তখন ইন্দিরা গান্ধীর ‘গরিবি হটাও’ স্লোগানে মাতোয়ারা গোটা দেশ। বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হলেন সোমেন-প্রিয়’র ছায়াসঙ্গী। জীবনের প্রথম ভোট-যুদ্ধে বাজিমাৎ। বিধায়ক হয়ে বিজয়ীর হাসি। পরের বছর ফের জয়ী হয়ে মন্ত্রী। সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের মন্ত্রিসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। এরপর কেন্দ্র বদল। ১৯৮২, ১৯৮৭, ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জোড়াবাগান কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৯৬ সালে জয়ী হন চৌরঙ্গী কেন্দ্র থেকে। ১৯৯৯ সালে যোগ দেন তৃণমূলে। ২০০১ সালে ফের চৌরঙ্গী বিজয়। ২০১১ সালে পালাবদলের হাওয়া। সুব্রতবাবু ফিরলেন সেই বালিগঞ্জে। রাজ্যে তৃণমূল সরকার গঠনে তাঁকে দু’হাত ভরে আশীর্বাদ করল তাঁর পুরনো কেন্দ্র। ফের মন্ত্রীর কুর্সিতে তিনি। ২০১৬ সালেও জয়ের ধারা অব্যাহত। এবার একুশের ভোটে সেই বালিগঞ্জ (Ballygunge)। সেখান থেকে জয়ের ‘হ্যাটট্রিক’ করার দৌড়ে ইতিহাসের কৃতী ছাত্র। আর সেটা হলেই সংসদীয় জীবনে ‘হাফ সেঞ্চুরি’র গড়বেন সুব্রতবাবু।
পারবেন কি গড়তে? ‘এত অঙ্ক কষে ভোটের লড়াইয়ে কোনওদিন নামিনি। এবারও নয়। তবে শুধু এটাই বলতে পারি আমি জিতব।’—অত্যন্ত প্রত্যয়ী প্রাক্তন ছাত্রনেতা। দক্ষিণ কলকাতার মাটি, তৃণমূলের শক্ত ঘাঁটি বলেই পরিচিত। সেই ঘাঁটিতে বালিগঞ্জ আরও দুর্ভেদ্য। অনেকেই বলছেন তৃণমূলের ‘সেফ সিট’। কারণ, দক্ষিণে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনপ্রিয়তা আজও অটুট। নেত্রীর জনপ্রিয়তায় অনুঘটক সুব্রতবাবুর ব্যক্তি ইমেজ। বালিগঞ্জের, বহুতল, বস্তি, অলিগলির সকলেই তাঁর আপনজন। তিনিও অন্যের। সংখ্যালঘু সমাজেও সুব্রতবাবুর গ্রহণযোগ্যতা কিছু কম নয়। সেটাকে ভাঙতে চিকিৎসক ফুয়াদ হালিমকে আবারও বাজি ধরেছে সংযুক্ত মোর্চা।
ফলে, বালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে মূল লড়াইটা হচ্ছে তৃণমূল বনাম সিপিএমের। মোর্চার প্রার্থী হালিম একেবারেই নতুন যোদ্ধা নন। এর আগেও একাধিক নির্বাচনে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। সেই প্লাস পয়েন্ট—তিনি একজন সফল চিকিৎসক। নিজেই জানিয়েছেন, আট হাজারেরও বেশি রোগী তাঁর কাছ থেকে চিকিৎসা পরিষেবা নেন। এছাড়াও অতি স্বল্প মূল্যে ডায়ালিসিস নেন আরও হাজারের উপর মানুষ। ২০১১ সালের নির্বাচনে সুব্রতবাবুর বিরুদ্ধেই দাঁড়িয়েছিলেন ফুয়াদ। জিততে পারেননি। সুব্রতবাবু পেয়েছিলেন ৬০ শতাংশের উপর ভোট। সিপিএমের পকেটে এসেছিল মাত্র ৩২ শতাংশ। এবার ফুয়াদ বলছেন, ‘কোনও লুটপাট, জাতপাত চাই না। আমরা চাই, জনগণের সরকার। দেখে নেবেন এই দাবিতেই হাফ সেঞ্চুরি করার আগে বোল্ড আউট হয়ে যাবেন সুব্রতবাবু।’
আর বিজেপি’র প্রার্থী লোকনাথ চট্টোপাধ্যায় ভোট চাইছেন বালিগঞ্জের সার্বিক উন্নয়নের স্বার্থে। পেশায় আইনজীবী লোকনাথবাবু প্রচারে বলছেন, ‘এখনও বালিগঞ্জের প্রকৃত উন্নয়ন হয়নি। বিজেপি সরকারে এলে সেটাই করে দেখাবে।’ লোকনাথবাবুর এই বার্তা ধাক্কা খাচ্ছে বালিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়। কথা হচ্ছিল পাম অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা শাহিল ওয়ারসির সঙ্গে। তিনি বলছিলেন, ‘বিজেপি বলছে সোনার বাংলা গড়বে। কিন্তু সেই দলের সদস্য এবং প্রার্থীকেই তো বালিগঞ্জের অধিকাংশ লোকই চেনেন না। বরং বেশি পরিচিত চিকিৎসক ফুয়াদ হালিম। সুব্রতবাবু তার থেকে আরও বেশি।’ তৃণমূল প্রার্থীর এই ব্যক্তি ক্যারিশমার ছবি ধরা পড়েছে গত লোকসভা ভোটেও। ফলাফলের নিরিখে অধিকাংশ ওয়ার্ডেই এগিয়ে রাজ্যের শাসক দল। সার্বিকভাবে বালিগঞ্জে প্রায় ৫৫ হাজার ভোটে এগিয়ে ছিল জোড়াফুল শিবির। ফলে, বড় কোনও ‘অঘটন’ না ঘটলে সুব্রতবাবুর ‘হাফ সেঞ্চুরি’র পথ আপাত মসৃণ। আর দ্বিতীয় স্থানের লড়াইয়ে সিপিএম বনাম বিজেপি।