ফোনে চিকিৎসা! গাজিয়াবাদের তরুণীকে বাঁচালেন কলকাতার ডাক্তার
ফোনটা বেজে উঠেছিল গত ২৮ এপ্রিল সন্ধ্যায়। অচেনা নম্বর। ‘ট্রু কলার’ জানান দিচ্ছিল ‘ইতি, গাজিয়াবাদ’। বেশ কয়েক বার ওই নম্বর থেকে কল আসার পরেই ফোনটি ধরেন শুভ্রজ্যোতি ভৌমিক। তাঁর কথায়, ‘‘প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে এক তরুণী শুধু বললেন, ‘স্যর আমাকে বাঁচান। মরে যাব’। তার পরেই ফোন কেটে যায়।’’ বাইপাসের এক হাসপাতালে দিন-রাত এক করে তখন করোনা রোগীদের চিকিৎসা করছেন শুভ্রজ্যোতি।
ওই নম্বরে বেশ কয়েক বার কল ব্যাক করার পরে সুমিত শর্মা নামে এক ব্যক্তি ফোন ধরে জানান, গাজিয়াবাদের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে করোনায় (Coronavirus) আক্রান্ত স্ত্রীকে ভর্তি করেছেন তিনি। সেখানে চিকিৎসার কোনও ব্যবস্থা নেই। শুধু প্যারাসিটামল আর অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। রোগীরা পরপর মারা যাচ্ছেন।
শুভ্রজ্যোতি বলেন, ‘‘রোগিণীর স্বামী ফোনে জানালেন, অক্সিজেন দিয়েও ৮৮-র বেশি উঠছে না। ১০৪ ডিগ্রি জ্বর। আমি ফোনটা তরুণীর কাছে নিয়ে যেতে বলি। প্রথমেই তাঁকে বললাম, ‘‘তুমি মরবে না। যাঁরা মরছেন, তাঁরা হয়তো মরার জন্যই এসেছিলেন। কিন্তু তুমি এখনও বেঁচে রয়েছ মানে, তুমি বাঁচবেই। শুধু মাথায় রাখ, তোমাকে বাঁচতেই হবে। ঠিকমতো ওষুধ খেলেই তুমি ঠিক হয়ে যাবে।’’ শুভ্রজ্যোতির কথায়, ‘‘চিকিৎসার প্রথম ধাপই হল, রোগীকে মানসিক ভাবে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত করা। এর পরে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসক ও কর্মীদের কাছ থেকে তরুণীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জেনে সুমিতকে হোয়াটসঅ্যাপে ওষুধ লিখে পাঠাই। চার ঘণ্টা অন্তর খোঁজ নিতে থাকি। আমার বলে দেওয়া ওষুধ ও ইঞ্জেকশন তরুণীকে দিতে শুরু করেন ওঁরা।’’
পরের দিন জ্বর নেমে আসে ১০২ ডিগ্রিতে। অক্সিজেনের মাত্রাও বাড়ে। শুভ্রজ্যোতি বলেন, ‘‘বুঝলাম, ওষুধ কাজ শুরু করেছে। ভিডিয়ো কলের মাধ্যমে তরুণীর সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের বললাম, কোনও ভাবে ওঁকে একটি আলাদা জায়গায় রাখার ব্যবস্থা করা হোক। কারণ, একের পর এক সঙ্কটজনক রোগীকে মারা যেতে দেখে ওই তরুণী মানসিক জোর হারিয়ে ফেলতে পারতেন। অন্যান্য রোগীদের জন্যও সেখানকার স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের কিছু পরামর্শ দিয়েছিলাম। তাঁরা তা প্রয়োগও করেছেন।’’
শুভ্রজ্যোতি জানান, এর পরে ধীরে ধীরে ওই তরুণীর জ্বর নামতে থাকে। গত ২ মে তা কমে হয় ৯৯। অক্সিজেন দেওয়া অবস্থায় সেই মাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ৯৪। তাঁর কথায়, ‘‘বিপদ কেটে গিয়েছে বুঝে ৪ মে অক্সিজেনের নল খুলে নিতে বলি। এর পরে ওষুধ ও ইঞ্জেকশনের পাশাপাশি হাল্কা শ্বাসের ব্যায়াম করার পরামর্শ দিই।’’
গত ৭ মে দেখা যায়, অক্সিজেনের মাত্রা বেড়ে ৯৭ হয়েছে। তাপমাত্রা স্বাভাবিক। তা সত্ত্বেও অল্প শ্বাসকষ্ট রয়ে গিয়েছে। এর পরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ওই তরুণীকে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেন শুভ্রজ্যোতি। পরদিন ওই তরুণী বাড়ি ফিরে যান। এখনও অল্প শ্বাসকষ্ট হয়েছে তাঁর। শুভ্রজ্যোতি বলেন, ‘‘ওষুধের পাশাপাশি প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার খেতে ও দিনে তিন-চার বার ফুসফুসের ব্যায়াম করতে বলেছি। মাঝেমধ্যেই আমার হোয়াটসঅ্যাপে ওই তরুণীর ফুসফুসের ব্যায়ামের ছবি ভেসে উঠছে। এখনও পুরোপুরি সুস্থ নন। চার থেকে আট সপ্তাহ সমস্ত নিয়ম মেনে চলতে বলেছি।’’
ইতি শর্মা নামের ওই তরুণী ফোনে বললেন, ‘‘ভগবান নন, ডাক্তারবাবুর জন্যই আমি বেঁচে ফিরেছি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই কলকাতায় গিয়ে ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করব।’’ কিন্তু ডাক্তারবাবুর মোবাইল নম্বর পেলেন কী ভাবে? সুমিত বললেন, ‘‘বছর দুয়েক আগে আমার এক আত্মীয়কে কলকাতার বাইপাসের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। সেই সময়ে এই ডাক্তারবাবুই সব দেখাশোনা করেছিলেন। আমরা ওঁর ফোন নম্বরটা নিয়েছিলাম। কোনও অসুবিধা হলে ফোন করব বলেছিলাম। সে দিন শেষ আশা হিসেবে ওঁকে ফোন করেছিলেন আমার স্ত্রী। উনি যেন ডাক্তার রূপে সাক্ষাৎ ভগবান।’’
গাজিয়াবাদের ওই এলাকার চিকিৎসক বিবেক শর্মা বললেন, ‘‘এখানে পরিকাঠামো নেই। করোনার অভিজ্ঞ চিকিৎসকও নেই। শহরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই রোগীর মৃত্যু হচ্ছে। শুভ্রজ্যোতিবাবুর পরামর্শই ওই তরুণীর প্রাণ বাঁচিয়ে দিয়েছে।’’
ওই তরুণী কলকাতায় এলে ফি হিসেবে কী নেবেন? শুভ্রজ্যোতি হেসে বললেন, ‘‘খুব বেশি হলে এক কাপ লিকার চা আর একটা বিস্কুট।’’ তাঁর কথায়, ‘‘ওই তরুণীর কোনও কোমর্বিডিটি ছিল না। শুধু ওষুধ নয়, মনের জোরও মানুষকে সারিয়ে তোলে। তাই আগে ওঁকে মানসিক ভাবে চাঙ্গা করার চেষ্টা করি। তার পরে ওষুধ ও ইঞ্জেকশন।’’