বাংলার নিজস্ব কালোনুনিয়া ধানের স্বীকৃতি আদায়ে আসরে রাজ্য
‘নুনিয়া ধানের মুড়িরে মোর/ খাইতে লাগে মজা / মরি হায়রে হায় /দিনের মুড়ি দিনেই বেচা যায়/ বসিয়া নাহি রয়/…।’
জলপাইগুড়ির গ্রামগঞ্জে এ এক অতি পুরনো লোকগান। সেসব অঞ্চলে গেরস্তের ঘরে ঘরে জমানো থাকে ‘কালোনুনিয়া’। লোকের মুখে মুখে তার ডাক নাম ‘কালোজিরে’। আর যাঁরা খাদ্যরসিক, গরম ভাতে একটু ঘি আর কাঁচালঙ্কা চটকে তৃপ্তিভরে খান, তাঁরা আদর করে বলেন ‘চালের রাজা’। মূলত উত্তরবঙ্গের জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা বাংলার অন্যতম প্রাচীন ধানের নাম কালোনুনিয়া। প্রবাদ বলে, এই অঞ্চলে নাকি এই ধান বুনে গিয়েছিলেন মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৃষ্ণবর্ণের এই সুগন্ধি চাল বাংলার নিজস্ব সম্পদ। ভূ-ভারতে আর কোথাও পাওয়া যায় না এই কালোনুনিয়া। তাই এই চালকে বাংলা সম্পদ হিসেবেই স্বীকৃতি চাইছে রাজ্য। সম্প্রতি জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশন বা জিআইয়ের জন্য আবেদন করা হয়েছে।
অন্যান্য চালের থেকে কোথায় আলাদা কালোনুনিয়া? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই চালের মূল বৈশিষ্ট্য হল, ধানের রং কালো এবং অত্যন্ত সুগন্ধি। এর গড়নও সুন্দর এবং চাল ফোটালে ঝরঝরে ভাত হয়। বাংলার জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার এবং দার্জিলিংয়ের কিছু অংশে এই চালের উৎপাদন হয়।
কালোনুনিয়া যে একমাত্র বাংলারই সম্পদ, তা প্রমাণ হবে কীভাবে? ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব সোশ্যাল সায়েন্স-এ অশোক দাশগুপ্ত লিখেছেন, কথিত আছে, ফাঁসিদেওয়া ব্লকের বিধাননগরের কাছে একটি গ্রামে ভীম নামে এক ব্যক্তি বাস করতেন। চাষাবাদ ছিল তাঁর পেশা। তাঁর বাড়িতে জমিয়ে রাখা বেশ কিছু ধানের বীজে একদিন আচমকাই আগুন লেগে যায়। কয়েক মাস পর তিনি লক্ষ্য করেন, সেই পুড়ে যাওয়া বীজগুলির মধ্যে থেকে কয়েকটি কালো ধান বীজ অক্ষত রয়ে গিয়েছে। সেগুলি বপন করেন তিনি। কালো ধানে ভরে ওঠে তাঁর জমি। ১৮৭৬ সালে স্ট্যাটিস্টিক্যাল অ্যাকাউন্টস অব বেঙ্গল নামে একটি বইয়ে ব্রিটিশ লেখক ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার লিখেছেন, আমন এবং হৈমন্তী ধানের ২৪টি রকম বা ‘ভ্যারাইটি’ পাওয়া যেত দার্জিলিং ও সংলগ্ন তরাই অঞ্চলে। তারই এক রকমের ধান হল ‘নেনিয়া’। ইউরোপের দেশগুলিতে বহু মানুষ পছন্দ করতেন সেই নেনিয়া ধানের স্বাদ আর গন্ধ। সেই নেনিয়া ধানই আজকের কালোনুনিয়া। অর্থাৎ প্রায় দেড় শতক আগে বাংলার এই ধান যে বিদেশে রপ্তানি হতো, সেই তথ্য পাওয়া যাচ্ছে এই বই থেকেই।
কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতে দ্রোণ পর্বে উল্লেখ রয়েছে কালো ধানের। বিরাট রাজার আশ্রয়ে যখন ছিলেন পঞ্চপাণ্ডব, তখন অর্জুন এবং ভীম চাষাবাদে নামেন। অনেক চেষ্টার পর তাঁরা মাত্র দু’আঁটি ধান উৎপাদন করতে পেরেছিলেন। সেই রাগে ধানে আগুন ধরিয়ে দেন ভীম। সেই আগুনে বিস্ফোরণ ঘটেছিল। পাণ্ডবরা দেখেছিলেন, কালো ধান ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সেখানে। স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, হিমালয়ের পাদদেশে পাণ্ডবদের চাষাবাদের আশীর্বাদ আজও বহন করে চলেছে কালোনুনিয়া। এই ধানের অস্তিত্ব তাই আর কোথাও নেই।
কোনও একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে যদি কোনও একটি বিশেষ দ্রব্য উৎপাদিত হয়, তাহলে তার জন্য জিআইয়ের জন্য আবেদন করা যায়। কোনও পণ্যের জিআই স্বীকৃতি পাওয়ার অর্থ, সেটি একমাত্র ওই অঞ্চলেই উৎপাদিত হয়, অন্য কোথাও নয়। মূলত আন্তর্জাতিক স্তরে বাণিজ্য বাড়ানোর জন্যই জিআই তকমার আবেদন করা হয়।
কালোনুনিয়া ধানের জিআই তকমা পাওয়ার জন্য আবেদন করেছে স্টেট এগ্রিকালচারাল ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড এক্সটেনশন ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এবং উত্তরবঙ্গ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। চেন্নাইয়ের ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অফিস কবে সেই স্বীকৃতি দেয়, তার দিকে এখন তাকিয়ে রাজ্য।