বিনোদন বিভাগে ফিরে যান

বাবা মৃণাল সেনের জন্মদিনে স্মৃতিচারণ কুনালের

May 16, 2021 | 3 min read

কাজের ব্যস্ততা প্রচুর। তার ওপর মৃণাল সেনের (Mrinal Sen) জন্মদিনের স্মৃতি, তাঁর জীবনের ভাল-মন্দ দিক তুলে ধরা সহজ নয় আমার কাছে। লিখতে বসে গত ২ দিন ধরে খালি মনে হচ্ছে, বেঁচে থাকলে ১৪ মে বাবা ৯৮ হতেন। কোনও দিনই মৃণাল সেনের জন্মদিনে ঘটা ছিল না। বাবা যখন কর্মব্যস্ত ছিলেন, তখনও আমাদের বাড়িতে মা-বাবার জন্মদিন পালিত হতে দেখিনি। অবাক হয়েছি, শেষের দিকে যখন দেখলাম ওঁর জন্মদিন বড় হয়ে উঠছে। কাগজে কাগজে লেখালিখি হচ্ছে। বাড়িতে লোকজনের ভিড়। তারও পরে নেটমাধ্যমে শুভেচ্ছা জানানোর হিড়িক। বাবার মতোই আস্তে আস্তে মা-ও শারীরিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। এত কিছু তিনিও আর সামলাতে পারছিলেন না। ফলে, শেষ দিকে বাবার জন্মদিনের আগে কলকাতায় চলে আসতাম। আর অবাক হয়ে দেখতাম, একটা মানুষ কাজের মধ্যে দিয়ে কত লোকের শ্রদ্ধা, ভালবাসা পাচ্ছেন। ভালও লাগত খুব।

এ বছর বাবার জন্মদিনের দিন বার বার মনে হচ্ছিল, আমাদের কপাল ভাল যে এই বছর ওঁরা আর নেই। শেষের দিকে ওঁরা ২জনেই খুব অসহায় অবস্থার মধ্যে বেঁচে ছিলেন। মানুষের সাহায্য ছাড়া কিছুই প্রায় করতে পারতেন না। ভেবে আতঙ্কিত হয়েছি, অতিমারির মধ্যে ওঁরা কী করে নিজেদের সামলে রাখতেন? সংক্রমণ থেকে দূরে থাকতে পারতেন কি? আমাদের পক্ষেও এত দূর থেকে কিছুই করা সম্ভব হত না।

এ বছরেও বাবার জন্মদিনে নেটমাধ্যমে শুভেচ্ছাবার্তা পোস্ট হয়েছে। বহু জন স্মরণ করেছেন মৃণাল সেনকে। এই মনে রাখা আর কত দিন? তার মধ্যে কী বিভ্রান্তি! এক নেটাগরিক জন্মদিনে বাবাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে পোস্ট করেছেন। সেই পোস্টে বাবার বদলে পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের (Ritwik Ghatak) ছবি! এই ভুলের কথা এই জন্যেই জানালাম, কারণ যিনি পোস্টটি করেছেন তিনি বাবাকে জানেন। বাবার জন্মদিনও মনে রেখেছেন। কিন্তু যাঁকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন তাঁর মুখ, চেহারা আর ভাল করে মনে নেই তাঁর। এই পোস্ট ঘিরে আমার রাগ বা কোনও খারাপ লাগা নেই। মনে হয়েছে, এটাই বোধ হয় স্বাভাবিক। আস্তে আস্তে এই সব স্মৃতিগুলো মুছে যাবে এক দিন। খুব বেশি মানুষ বাবার ছবি দেখেননি। এখনও দেখেন না। জানি, এই সংখ্যাটা ক্রমশ আরও কমবে। এটা শুধু মৃণাল সেনের ক্ষেত্রেই নয়। যখন অনেক অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের জিজ্ঞেস করি তাঁরা সত্যজিৎ রায়ের কী কী ছবি দেখেছেন, উত্তরে বেশির ভাগই জানান ‘গুপি-বাঘা’, ‘ফেলুদা’র নাম। অর্থাৎ, সত্যজিৎ রায়ের সিরিয়াস ছবি তাঁরা প্রায় দেখেনইনি! শুনে খুব খারাপ লাগে।

যদিও আমার বাবা কোনও দিন স্মৃতি রোমন্থনকে প্রশ্রয় দেননি। কোনও দিন নিজের লেখা চিঠি যত্নে জমিয়ে রাখার চেষ্টা করেননি। বাবার আগ্রহও ছিল না। ২০ বছর আগে মা-বাবা বাড়ি বদলান। তখন সামান্য যে ক’টি চিত্রনাট্য, চিঠি ছিল সে সবও ফেলে দিয়ে চলে আসেন। আমি যখন কলকাতায় পৌঁছলাম, দেখি কোথাও কিচ্ছু নেই। বাবার মৃত্যুর পর তন্ন তন্ন করে খুঁজে সামান্য কয়েকটি চিঠি, কাগজ, কিছু লেখাপত্র পেয়েছিলাম। পরে সেগুলোই শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রহশালায় পাঠিয়ে দিলাম। অনেকেই জিজ্ঞেস করেছিলেন, কলকাতায় নয় কেন? আমার উত্তর, কলকাতায় এ রকম কোনও সংগ্রহশালা বা সংস্থা আছে কিনা জানি না। কিন্তু এটা জানি, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় ভীষণ যত্নে বাবার সব কিছু রেখে দেবে। ২০০ বছর পরেও মৃণাল সেনকে কেউ জানতে চাইলে তাঁর জিনিসপত্র এখন যেমন আছে তখনও তেমনই দেখতে পাবেন।

এই প্রসঙ্গে বলি, আমরা বাঙালিরা আমাদের সংস্কৃতিবোধ নিয়ে প্রচণ্ড গর্ব করি। বলি, অন্যদের থেকে আমাদের এই অনুভূতি নাকি প্রখর। সেটাও বোধ হয় ঠিক নয়। ১৯৮০-র দশকে বাবা ছোটপর্দার জন্য একটি সিরিজ বানিয়েছিলেন ‘কভি দূর কভি পাস’। ডজনখানেক ছোট ছবির একটি সংকলন। কলকাতা দূরদর্শনে প্রতি রবিবার একটি করে পর্ব দেখানো হত। সবাই জানি, ছোট পর্দা বিজ্ঞাপনের উপর চলে। তাই কোনও এক সংস্থা ছোট পর্দার দর্শকসংখ্যা মাপত। তাদের থেকে জানতে পারি, বাবার ওই ছবি চেন্নাইয়ের দর্শক দেখতেন বেশি। কলকাতার দর্শক সংখ্যা সেই তুলনায় নগণ্য!
বছর ২০ আগে কোনও প্রয়োজনে সেই সিরিজের একটি কপি বাবা কলকাতা দূরদর্শনের কাছে চেয়েছিলেন। বাবার কাজগুলো রেকর্ড করা হয়েছিল ম্যাগনেটিক টেপে। তখনই জানতে পারেন, টেপের অভাবে বাবার সিরিজের ওপরেই অন্য জন তাঁর কাজ বন্দি করেছেন। মৃণাল সেনের ‘কভি দূর কভি পাস’-এর উপর কেউ তাঁর কাজ রেকর্ডিং করেছেন! ভাবা যায়?

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Ritwik Ghatak, #Mrinal Sen

আরো দেখুন