কলকাতার ব্রাত্যজনেদের ‘মুক্ত’ সঙ্গীত – ট্যাংরা ব্লুজ
ট্যাংরা – কলকাতার অনামী অঞ্চলগুলোর অন্যতম নাম। শহরের ফেলে দেওয়া নোংরা জঞ্জাল এসে জমা হয় এই বস্তিতে। কিন্তু সেখানে যারা বাস করে, সেই সহ-নাগরিকদের সম্পর্কে কতটা ওয়াকিবহাল তিলোত্তমা? হাইরাইজের ভিড়ে হারিয়ে যায় তাদের কথা। তাই তো ‘মৃতদের’ এই শহরকে জাগাতে দরকার হয় চিৎকারের। দরকার পড়ে সঞ্জীব মণ্ডলের মত মানুষের – যিনি চার্লটন মুর্মুর মত বস্তির বাচ্চাদের মুক্তির আস্বাদ দেন গানের মাধ্যমে।
এই গল্প জয়ীরও। মুম্বইয়ের এক উঠতি সঙ্গীত পরিচালক। পেশাগত অসাফল্যের জেরে কলকাতায় নিভৃতাবাসের উদ্দেশ্যে কলকাতায় আগমন তার। ট্যাংরায় বাবার অ্যাপার্টমেন্টে থাকতে শুরু করেন তিনি। রাস্তায় সঞ্জীব মণ্ডলের গ্রূপকে শো করতে দেখে মুগ্ধ হয়ে যান জয়ী। আর এখানেই গল্পের সূত্রপাত।
পরিচালক সুপ্রিয় সেনের এই ছবি পয়লা বৈশাখ মুক্তি পেয়েছিল প্রেক্ষাগৃহে। এবার ডিজিটাল প্রিমিয়ার হল হইচই-তে। ছবিতে দুই মুখ্য চরিত্র- জয়ীর ভূমিকায় অভিনয় করছেন মধুমিতা সরকার এবং সঞ্জীব মণ্ডলের ভূমিকায় রয়েছেন পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়। চার্লটন মুর্মুর ভূমিকায় সমিউল আলম।
কলকাতার অলিতে গলিতে যে প্রচুর প্রতিভা রয়েছে, ট্যাংরা ব্লুজ (tangra blues) সেই প্রতিভাকেই সামনে আনার একটি প্রয়াস করেছে। বলিউডের ‘গল্লি বয়’ এর মত এই ছবিতে জয়গান রচিত হয়েছে কলকাতার ব্রাত্যজনেদের। যে জঞ্জাল সারা শহর থেকে এসে জড়ো দিয়ে যায় ট্যাংরার বস্তিতে, সেই ফেলে দেওয়া জিনিস দিয়েই যন্ত্র তৈরি করে সঙ্গীত সৃষ্টি হয়। ভাঙা ড্রাম, টিন, কৌটো, ঘণ্টা, কঞ্চি, কাঠি, বাটি, ঘটি পরিণত হয় গিটার, হারমোনিয়াম, পিয়ানো, তবলা, ব্যাঞ্জোতে।
পাশাপাশি, ছবিতে উঠে এসেছে ট্যাংরা এলাকার সমাজবিরোধীদের কর্মকাণ্ড এবং বাংলার রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের খণ্ডচিত্রও। আর এখানেই ‘গল্লি বয়’ কে মাত দেয় ট্যাংরা ব্লুজ। কারণ, এটি শুধুই বস্তির ছেলেদের অসাধ্য সাধনের রূপকথা নয় – এই ছবিতে আছে সমাজের রূঢ় বাস্তবও। ট্যাংরার আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক ছবি তুলে ধরে সাদামাটা ছবিকে এক উৎকর্ষে নিয়ে গেলেন পরিচালক। তাই তো চালু প্রতিবাদের সুরে গেয়ে ওঠে “গল্প নয়, ছিল সত্যিকারের দিন / গল্প নয়, যা বলছি সত্যিই / বাঁচতে চাওয়ার ছিল না শক্তি / এটাই আমার জীবন বুঝবি রে তোরা মন দিয়ে শোন…”।
পরমব্রত, মধুমিতার মত পরিণত শিল্পীর সাথে স্ক্রিন শেয়ার করেও নিজের স্বকীয়তায় সিনেমাজুড়ে সমুজ্জ্বল সামিউল আলম। ‘সহজ পাঠের গপ্পো’ থেকে সে অনেকটাই পরিণত। বেশ সাবলীল অভিনয় তার। পাশাপাশি, অন্যান্য কমবয়সী ছেলেমেয়ের অভিনয়ও মুগ্ধ করে। লেখনী এবং অভিনয় ব্যাতিত আর যে বিভাগকে বাহবা দিতেই হয়, সেটি হল চিত্রগ্রহণ। রঞ্জন পালিতের দৃশ্যকল্প এবং চিত্রায়ণ কুর্ণিশযোগ্য। প্রতিটি ফ্রেমে আলোর সাযুজ্য এবং আলো-আঁধারির মেলবন্ধন ফুটিয়ে তোলে গল্পের মুড। আর যে ছবির নামেই ব্লুজ, তার সঙ্গীত নিয়ে কোনও কথা না বলে রিভিউ কীভাবে শেষ হয়। নবারুণ বসুর আবহ ও গান মুগ্ধ করে।
দশ বছর আগে কলকাতার বস্তির ছেলেদের সঙ্গীতকে সারা দেশের কাছে তুলে ধরেছিলেন সঞ্জয় মণ্ডল। তাঁর জীবনকাহিনী অবলম্বনে তৈরি এই ছবি হয়তো আসার আলো দেখাবে তিলোত্তমার গল্লি বয়দের।