নারদ নাটকে তৃণমূলের অ্যাডভান্টেজ, কপাল পুড়ল দলের, মত বিজেপির অন্দরেই
বিধানসভা ভোটে হেরে নিজেদেরটা নিজেরাই বুঝে নিতে চেয়েছিলেন দিলীপ ঘোষরা। প্রধান বিরোধী দল হিসেবে রাজনৈতিক ভাবে তৃণমূলের মোকাবিলা করাই ছিল এই রাজ্যের বিজেপি নেতাদের অনেকের পরিকল্পনা। কিন্তু সোমবার সাতসকালে রাজ্যের দুই মন্ত্রী-সহ তৃণমূলের তিন শীর্ষ নেতা সিবিআইয়ের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর গেরুয়া শিবিরের অনেকেরই অভিমত, কেন্দ্রীয় সরকারের এই পদক্ষেপ বঙ্গ-বিজেপির রাজনৈতিক লড়াইয়ে কার্যত জল ঢেলে দিল।
রাজনৈতির পর্যবেক্ষকদের অনেকেরই অভিমত, রাহুল সিনহার মতো গুটি কতক বিজেপি নেতা স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে যতই দাবি করুন যে, সিবিআইয়ের হাতে তৃণমূল নেতা-মন্ত্রীদের গ্রেপ্তারে বিজেপির কোনও সম্পর্ক নেই, তাঁদের দলের অনেকের মতো এই ছেঁদো তত্ত্ব সাধারণ ভাবে বাংলার আমজনতা বিশ্বাস করবে না। এ যেন, ঠাকুরঘরে কে, আমি তো কলা খাইনি- এমন কথার মতো বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অভিমত।
নারদ মামলায় সিবিআই তদন্ত চলছে। সিবিআই স্বশাসিত সংস্থা। তারা তদন্তের স্বার্থে কাকে গ্রেপ্তার করবে, সেটা তাদের নিজস্ব ব্যপার। এর সঙ্গে বিজেপির কোনও লেনদেন নেই।’ বিজেপি সূত্রের খবর, মুখে এ কথা বললেও ওই নেতারা বিলক্ষণ জানেন, এ দিনের সিবিআই অভিযানের খেসারত রাজনৈতিক ভাবে বঙ্গ-বিজেপিকে দিতে হবে।
করোনা অতিমারীর মধ্যে রাজ্যের দুই গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের মন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করা নিয়ে এ দিন সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। রাজ্য বিজেপি বহু নেতারই অভিমত, আইন আইনের পথে চলবে ঠিকই, কিন্তু ভোট চুকে যাওয়ার পর তৃণমূল নেতাদের গ্রেপ্তার করার ঘটনাকে সবাই বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিহংসা বলেই ধরে নেবে। রাজনীতির ময়দানে যার কড়া মূল্য চোকাতে হবে দিলীপদেরই। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, ‘করোনা আতঙ্ক সবাইকে গ্রাস করেছে। এর মধ্যে পাঁচ বছরের পুরনা মামলা টেনে সিবিআই এ দিন দিনভর যা কাণ্ড করল, তাতে সহানুভূতির হাওয়া তৃণমূলের পালেই লাগবে।’
নারদ মামলায় বিজেপির দুই শীর্ষ নেতাও অভিযুক্ত। শুভেন্দু অধিকারী এবং মুকুল রায়। এর মধ্যে শুভেন্দু আবার বিধানসভার বিরোধী দলনেতা। এ দিন তৃণমূল প্রশ্ন তুলেছে, নারদ মামলায় তৃণমূল নেতাদের গ্রেপ্তার করা হলে কেন ছাড় দেওয়া হল শুভেন্দুদের? বিজেপিতে নাম লেখানোর কারণেই কি তাঁদের গ্রেপ্তার করা হলো না? এ সব প্রশ্নের সদুত্তর নেই রাজ্য বিজেপি নেতাদের কাছে। তাঁরা শুধু বলছেন, আইন আইনের পথে চলবে।
এ দিন সুব্রত-ফিরহাদ-মদনদের গ্রেপ্তার হওয়ার খবর পেয়ে নিজাম প্যালেসে ছুটে গিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়। লড়াকু মেজাজে টানা পাঁচ ঘণ্টার বেশি সময় তিনি ঠায় বসে থেকেছেন সেখানে। রাজ্য বিজেপি নেতাদের অনেকেরই মতে, শাসক-বিরোধী দু’টি সত্তার প্রকাশ সমান ভাবে করছেন মমতা। মাঝখান থেকে বিজেপি প্রাসঙ্গিকতা হারাচ্ছ রাজ্য রাজনীতিতে। রাজ্য বিজেপির এক শীর্ষ নেতার যুক্তি, ‘অমিত শাহরা বুঝতে পারছেন না, তাঁরা বাংলায় বিজেপির কত বড় সর্বনাশ করছেন। মমতা মুখ্যমন্ত্রী হয়েও রাস্তায় নেমে আন্দোলনের সুযোগ পাচ্ছেন মোদী-শাহদের দৌলতে। আর আমরা এ রাজ্যে বিরোধী দল হয়েও হাত গুটিয়ে বসে আছি সেই মোদী-শাহদের সুবাদেই।’ ওই নেতার ব্যাখ্যা, ‘লাগাতার লড়াইয়ের মাঠে থাকার ফলে মমতার গায়ে প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়ার আঁচ লাগছে না।’
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতো রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বেরও অনেকের আশঙ্কা, ভোটে জিততে না-পেরে বাংলায় রাষ্ট্রপতি শাসনের ‘ব্লু-প্রিন্ট’ তৈরির প্রস্তুতি চলছে দিল্লিতে। এ দিনের সিবিআই তৎপরতা এবং রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ের পর পর টুইট দেখে রাজ্য বিজেপি নেতাদের সেই সন্দেহ আরও জোরালো হয়েছে। তাঁদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় বিজেপির দুই শীর্ষ নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক (সাংগঠনিক) বি এল সন্তোষের বক্তব্যও এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। কৈলাস বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করার শপথ নিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন তিনি নিজেই সাংবিধানিক সংস্থাগুলোকে হুমকি দিচ্ছেন।’ বি এল সন্তোষের কথায়, ‘লকডাউন উপেক্ষা করেই শ’য়ে শ’য়ে তৃণমূলকর্মী দিনভর রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখালেন। তাঁদের জন্য কোনও লকডাউনের কোনও বিধিনিষেধ নেই। কী অদ্ভুত পরিস্থিতি!’