ভোটের প্রচারে মোদি-শাহদের জন্য ‘রিজার্ভ’ ছিল ৯১১ জন ডাক্তার, বঞ্চিত মানুষ
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi) ২০ বার। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (Amit Shah) ৩১ বার। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা (JP Nadda) ৪০ বার। এছাড়া কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং(Rajnath Singh), উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ (Yogi Adityanath), মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি—ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণার পর ‘বাংলা দখলে’র চেষ্টায় দফায় দফায় রাজ্যে এসেছে ‘ট্যুরিস্ট গ্যাং’। আর তাঁদের জন্য প্রায় দু’মাস ধরে রাজ্যকে জোগাতে হয়েছিল ৯১১ জন ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মী এবং ২৩৩টি অ্যাম্বুলেন্স। দিনের একটা বড় সময় মেডিক্যাল টিমগুলি ছিল ওই ‘বহিরাগত’ ভিআইপিদের ‘সেবা’য়। তার জেরে করোনা সঙ্কটকালেও বঞ্চিত হন বাংলার সাধারণ মানুষ। তাঁরা অ্যাম্বুলেন্সের অভাবে কপাল চাপড়েছেন। হাসপাতালের ওয়ার্ডে ডাক্তারবাবুরা কেন সময়ে প্রিয়জনকে দেখতে এলেন না, এই ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন। কিন্তু, ‘আসল পরিবর্তনে’র নেশায় সেসব দেখেও দেখেননি বিজেপি নেতারা।
স্বাস্থ্যদপ্তর সূত্রের খবর, গত মার্চ থেকে এপ্রিলের শেষ, এই পর্বে শুধুমাত্র কলকাতা বিমানবন্দর এবং সংলগ্ন হেলিপ্যাড দিয়ে যাতায়াত করা জেড প্লাস ও অন্যান্য প্রথম সারির ভিভিআইপি-ভিআইপিদের জন্যই তৈরি রাখতে হয়েছিল ২৩৩টি মেডিক্যাল টিম! প্রোটোকল মেনে তিন ঘণ্টা আগে থেকে কলকাতা বিমানবন্দরে দাঁড়িয়েছিল অ্যাডভান্স লাইফ সাপোর্ট অ্যাম্বুলেন্স (এসিএলএস)। মেডিক্যাল টিমে ছিলেন একজন করে ফিজিশিয়ান, সার্জেন, অ্যানাসথেসিওলজিস্ট, নার্স ও সিসিইউ টেকনোলজিস্ট। সব কাজ ফেলে দু’মাস ধরে দিনের একটা বড় সময় তাঁরা বিমানবন্দরেই বসেছিলেন।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কনভয়ে তাঁদের চিকিৎসার নিজস্ব টিম থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বে নিয়ম অনুযায়ী রাজ্যের তরফে এসিএলএস অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে হয়। সেই সঙ্গে বিমানবন্দরে রাখতে হয় আরও একটি অ্যাম্বুলেন্স। শহর ছাড়ার পর যতক্ষণ না তাঁদের বিমান কলকাতার এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল পার করছে, ওই অ্যাম্বুলেন্স ও মেডিক্যাল টিম নড়তে পারে না।
উত্তর ২৪ পরগনার এক পদস্থ স্বাস্থ্যকর্তা বলেন, করোনার মধ্যে এইসব ভিভিআইপিদের ‘সেবা’ দিতে কী পরিমাণ স্বাস্থ্য পরিকাঠামো আমরা মানুষের কাজে লাগাতে পারিনি, বলবার নয়! একাধিকবার সারা রাত এইসব টিমকে বিমানবন্দর বা হেলিপ্যাডের সামনে রেখে দিতে হয়েছে। মানবিকতার খাতিয়ে লাগোয়া হোটেলে রাতে থাকা-খাওয়ার জন্য মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে মোটা টাকা।
স্বাস্থ্যভবনের এক শীর্ষ সূত্র জানিয়েছে, ভোটের প্রচারপর্বে বিজেপির হাইপ্রোফাইল নেতা-মন্ত্রীদের জন্য এসিএলএস অ্যাম্বুলেন্স রাখতে হয়েছিল ৬৫টি। বিভিন্ন প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে ১৬টি অ্যাম্বুলেন্স ধার করতে হয়েছিল। ছিল ১৫২টি সাধারণ অ্যাম্বুলেন্স। মেডিক্যাল টিমগুলিতে ছিলেন ৪৫০ জন এমও, ২৩৩ জন নার্স, ৯০ জন সিসিইউ টেকনোলজিস্ট। এ ছাড়াও ১৩৮ জন ফুড সেফটি অফিসারও (এফএসও) মোতায়েন রাখা হয়। এর কারণ হিসেবে এক কর্তা জানান, ভিভিআইপিদের দেওয়া খাবারে বিষ আছে কি না, তা খেয়ে পরীক্ষা করেন এফএসওরা! দীর্ঘদিন আগে প্রাক্তন স্বাস্থ্য অধিকর্তা ডাঃ অনিরুদ্ধ কর এই ধরনের মধ্যযুগীয় কাজ করতে বেঁকে বসেছিলেন। তারপরও সমানতালে চলছে সে কাজ।
বিজেপির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক সায়ন্তন বসু অবশ্য এতে দোষের কিছু দেখছেন না। তাঁর সাফ কথা, ‘প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চাইলে রোজ আসবেন। আর তাঁদের জন্য মেডিক্যাল টিমের ব্যবস্থা রাজ্যকেই করতে হবে।’ রাজ্যের মন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য এই প্রসঙ্গে বিজেপিকে একহাত নিয়ে বলেছেন, প্রোটোকল মানতে গিয়ে ‘বহিরাগত ট্যুরিস্ট গ্যাং’কে মানুষের জন্য বরাদ্দ স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে হয়েছে। তবে চিন্তা নেই, ভোটে ওঁদের ভেরি লেস ইমপর্টেন্ট পার্সনে পরিণত করেছে মানুষ।