গায়ের জোরে কেন্দ্র যেমন তেমনভাবে হেনস্তা করছে আলাপনকে, বলছেন আমলারা
‘আঁতে লেগেছে। তাই গায়ের জোরে কেন্দ্র যেমন তেমনভাবে হেনস্তা করছে আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়কে।’ আলাপন-পর্বে এই কড়া প্রতিক্রিয়া রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যসচিব অর্ধেন্দু সেনের। আর শুধু তিনিই নন, এই ইস্যুতে দেশের প্রত্যেক প্রান্তে একই সুরে সরব হচ্ছেন প্রাক্তন আমলারা। তাঁদের সাফ কথা, নরেন্দ্র মোদি সরকার উচিত কাজ করছে না। কারণ, যে ইস্যু দেখিয়ে তাঁকে তথা বাংলাকে হেনস্তা করা হচ্ছে, তা মোটেও কাঙ্ক্ষিত নয়। প্রধানমন্ত্রীর রিভিউ বৈঠকে হাজির না থেকে রাজ্যের সদ্য প্রাক্তন মুখ্যসচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় বিপর্যয় মোকাবিলা আইন লঙ্ঘন করেছেন বলে মনে করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এটাই ইস্যু খাড়া করা হয়েছে আলাপনবাবুর বিরুদ্ধে। সেই প্রেক্ষিতে তাঁকে পাঠানো হয়েছে শো-কজ নোটিস। বিপর্যয় মোকাবিলা আইন, ২০০৫ সালের ৫১বি ধারা অনুযায়ী দোষী সাব্যস্ত হলে ওই আইনে এক থেকে দু’বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। সঙ্গে জরিমানাও। এই হুঁশিয়ারি সংবলিত নোটিস নিয়ে সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক মহল তো বটেই, প্রাক্তন আইএএস আধিকারিকদের মধ্যেও চরম বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে। দীর্ঘকাল ভারত ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বভার সামলে আসা এই আইএএস অফিসারদের প্রত্যেকেই একটি বিষয়ে একমত—আলাপনবাবু তাঁর কর্মজীবনের শেষ দিনে নিয়মমাফিক অবসর নিয়েছেন। কোনও এক্সটেনশন পর্যন্ত নেননি। কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত ছিল ওখানেই বিতর্কে ইতি টানা।
নোটিসে বলা হয়েছে, কলাইকুন্ডায় প্রধানমন্ত্রীর নির্ধারিত রিভিউ বৈঠকে হাজির না হওয়া মুখ্যসচিবের কর্তব্যে গাফিলতি। এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশিকা অমান্য করা। যথাযথ এবং আইনগত কারণ দেখাতে ব্যর্থ হলে এই আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনদিন সময় দেওয়া হয়েছে আলাপনবাবুকে। নবান্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে, আলাপনবাবু এই চিঠির উত্তর দিচ্ছেন। সোমবার বিকেলে অবসর নিয়েছেন তিনি। আর চিঠি এসে পৌঁছেছে রাতে। মঙ্গলবার তা হাতে পেয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যসচিব। জানা যাচ্ছে, উত্তরপত্রে কর্তব্য পালনের কথাই যুক্তি দিয়ে সাজিয়ে পেশ করবেন আলাপনবাবু। মুখ্যসচিব হিসেবে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মানতে বাধ্য। গত ২৮ মে তিনি সেটাই করেছিলেন। ঘূর্ণিঝড় যশ এবং কোটালে ক্ষতিগ্রস্ত তিন জেলায় তিনি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সফরসঙ্গী ছিলেন। এমনকী, কলাইকুন্ডায় বৈঠক স্থলে তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গেই প্রবেশ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির থেকে অনুমতি নিয়েই তিনি এবং মুখ্যমন্ত্রী দীঘায় তাঁদের নির্ধারিত বৈঠকে যোগ দিতে যান। সেক্ষেত্রেও তিনি বিপর্যয় মোকাবিলার কর্তব্যই করছিলেন বলে চিঠিতে উল্লেখ থাকতে পারে বলে নবান্ন সূত্রে খবর।
কেন্দ্রীয় সরকারের পরবর্তী পদক্ষেপ যাই হোক না কেন, অবসরপ্রাপ্ত আমলা মহল কিন্তু এই ঘটনায় রীতিমতো ক্ষুব্ধ। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় সচিব অনিতা অগ্নিহোত্রী বলেছেন, ‘আলাপনবাবু ওই শো-কজের কিছু একটা জবাব তো দেবেনই। তারপর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কী করবে? তারা কি কর্মিবর্গ দপ্তরকে প্রশাসনিক কোনও ব্যবস্থা নিতে বলবে? যাতে তিনি অবসরকালীন সুবিধাগুলি না পান? নাকি আদালতে তাঁর শাস্তি চাওয়া হবে? এই ব্যাপারটা আমাদের কাছে খুব স্পষ্ট নয়।’ অর্ধেন্দুবাবুর সাফ কথা, ‘এটা গা জোয়ারি ছাড়া কিছুই নয়। আসলে কিছু করে উঠতে পারছে না বলে অযথা হয়রানির মুখে ফেলছে।’ রাজ্যের আর এক প্রাক্তন মুখ্যসচিব সমর ঘোষও একই সুরে বলেন, ‘অবসর নেওয়ার পর ডিওপিটি আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নিতেই পারে না। আর পেনশন সহ অবসরকালীন কোনও সুযোগ-সুবিধাতেও বাধা দিতে পারে না কেন্দ্র। সংবিধান বা আইন তাকে মান্যতা দেয় না।’
পশ্চিমবঙ্গে প্রাক্তন মুখ্যসচিব বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায় তো সুর আরও চড়িয়েছেন। কেন্দ্রের এই নোটিসকে তিনি ‘লজ্জাজনক, উদ্ভট এবং ছেলেমানুষী’ আচরণ বলে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন। আর এক অবসরপ্রাপ্ত আইএএস অফিসার অমিতাভ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘আমরা, আইএএস মহল মনে করেছিলাম আলাপনবাবু অবসর নিয়ে নিলেন। ব্যাপারটা মিটে গেল। কেন্দ্রীয় সরকার যে এতটা এগবে এটা ভাবাই যায়নি। একটা কথা বুঝতে হবে… মুখ্যসচিব হলেন রাজ্য সরকারের অধীনে। সরকারের প্রধান মুখ্যমন্ত্রী। সুতরাং মুখ্যসচিব যে কাজই করেন, তা মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে। এক্ষেত্রে যাই হোক, আলাপনবাবুর ব্যক্তিগত কোনও ভূমিকা আছে বলে মেনে নেওয়াটা কষ্টকর। তাই তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে দোষী সাব্যস্ত করা যায় কি না, এটা প্রমাণসাপেক্ষ।’
জহর সরকার
খ্যমন্ত্রীর নির্দেশ পালনের জন্য একজন মুখ্যসচিবকে জেলে ভরার হুমকি দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী? এমন অবিবেচক পদক্ষেপ ভারতের ইতিহাসে নেই… সেটাই প্রধানমন্ত্রী বাংলায় করলেন। সাইক্লোনে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ সংগ্রহে একদিকে মুখ্যমন্ত্রী ও মুখ্যসচিব ব্যস্ত, অন্যদিকে তিনি উড়ে বেড়াচ্ছেন রাজনীতি ও ‘সুযোগসন্ধানে’। প্রতিহিংসার চূড়ান্ত নিদর্শন!
অর্ধেন্দু সেন
আলাপনের বিরুদ্ধে কোনও আর্টিকল চার্জ করেনি, প্রপার ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশনও নিতে পারেনি। আর ও অবসর নিয়ে নিয়েছে। এখন ওর বিরুদ্ধে কোনওরকম ব্যবস্থা নিতে পারে না কেন্দ্র। তাই বিপর্যয় মোকাবিলা আইনকে অস্ত্র করেছে। এই আইনে যে কোনও নাগরিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। এটা হেনস্তা করা ছাড়া কিছু নয়।
বাসুদেব বন্দ্যোপাধ্যায়
মুখ্যসচিব যদি কোনও বৈঠকে না গিয়ে থাকেন, তাহলে দায় তঁার নয়। কারণ, দিনের শেষে তিনি মুখ্যমন্ত্রী তথা রাজ্যের অফিসার। প্রধানমন্ত্রীর নন। আইএএস, আইপিএসদের দিল্লি ডেপুটেশনে নিতে পারে। দিল্লি থেকে ডেপুটেশনে কেউ রাজ্যে আসেন না। অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক আচরণের মুখে পড়তে হচ্ছে আলাপনকে। কেন্দ্র চিঠি দিয়ে রাজ্যের থেকে কৈফিয়ৎ চাইতে পারত! কিন্তু যেটা করেছে, তা ভালো হল না। দেশের প্রত্যেক অফিসার কিন্তু এই ঘটনাক্রমের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। এবং তাঁরা কেউ এই পদক্ষেপের সঙ্গে সহমত নন।
অনিতা অগ্নিহোত্রী
প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, আলাপনবাবুর অপরাধটা ঠিক কোথায়? সেদিন সাইক্লোন নিয়ে রিভিউ মিটিং ছিল। তিনি তো আগে থেকেই বিপর্যয় মোকাবিলায় ব্যস্ত ছিলেন! সেটা সবাই জানে। এটা কি তবে অন্য আইএএস অফিসারদেরও পরোক্ষে বার্তা দেওয়া, যাতে তাঁরা সন্ত্রস্ত থাকেন? সাধারণ নিয়মে অবশ্য রাজ্য সরকারই পারে তাঁর অবসরকালীন আর্থিক সুবিধা এবং পেনশন কার্যকর করতে। তবে কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছা করলে জটিলতা সৃষ্টি করতেই পারে।