দীঘায় বাঁধ দুর্নীতি – নেপথ্যে ‘পরিবারের’ পেটোয়া ঠিকাদাররা
বাঙালির প্রিয় উইকএন্ড ডেস্টিনেশন দীঘাকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে বিস্তর পরিকল্পনা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)। তাঁর পরিকল্পিত সৌন্দর্যায়ন প্রকল্প রূপায়ণে কোটি কোটি টাকা খরচ করে তৈরি হয়েছিল সমুদ্র বাঁধ আর মেরিন ওয়ে। উদয়পুর বিচ থেকে দীঘা মোহনা পর্যন্ত অংশ সেজে উঠেছিল নতুন চেহারায়। মোহনা থেকে শঙ্করপুর বাসস্ট্যান্ড হয়ে জলদা পর্যন্ত সমুদ্র পাড় বাঁধানোর কাজ চলছিল। অর্থ সরবরাহ স্বাভাবিক পন্থায় চললেও, সেই কাজের শম্বুক গতি নিয়ে বারবার সেচদপ্তরকে সতর্ক করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ঘূর্ণিঝড় ‘যশ’-এর (yaas) তাণ্ডব তাঁর আশঙ্কাকেই সত্যি প্রমাণ করেছেন। দীঘা-শঙ্করপুরজুড়ে বিধ্বস্ত মমতার সেই ‘ড্রিম প্রজেক্ট’। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ওই সব নির্মাণের দফারফা কীভাবে হল, ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে জরুরি ভিত্তিতে তার তদন্ত শুরু হয়েছে। প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, নির্মাণে ব্যবহৃত উপকরণের মান, পেটোয়া ঠিকাদারদের ‘দুর্নীতি’ এবং সরকারি বৃত্তে এক ‘পরিবারের অযাচিত অনুপ্রবেশের’ ঘটনা সামনে আসছে। সেচদপ্তরের এক আধিকারিকের ভূমিকাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অভিযোগ, অবসরের পর পুনর্বহালের আবেদনে প্রত্যাখ্যাত হয়েও তিনি হাল ছাড়েননি। ওই পরিবারকে ‘ম্যানেজ’ করে ফের এসেছেন স্বপদে। নির্বিঘ্নে কাটিয়েছেন আরও দু’বছর। নবান্ন সূত্রের দাবি, শুধু সেচদপ্তর নয়, দীঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদের ব্যবস্থাপনায় তৈরি হওয়া একাধিক নির্মাণ ধূলিসাৎ। খোঁজখবর চলছে সেগুলি নিয়েও।
যশ পরবর্তী পুনর্বাসন ও পুনর্গঠন নিয়ে জরুরি বৈঠকে ‘ড্রিম প্রজেক্টের’ এহেন পরিণতি নিয়ে সেচদপ্তরের আধিকারিকদের কাছ থেকে কৈফিয়ত তলব করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গে নির্মাণগুলি ভেঙে পড়ার কারণ অনুসন্ধানে তদন্তের নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। সেচদপ্তরের চিফ ইঞ্জিনিয়ারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। বিধ্বস্ত নির্মাণ পরিদর্শন করার পর সেই কমিটি প্রাথমিক যে রিপোর্ট পেশ করেছে, তা হল—১) উদয়পুর বিচ থেকে মোহনা পর্যন্ত অংশে নির্মাণে বড়সড় কোনও বিপত্তি হয়নি। ২) সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে মোহনা থেকে শঙ্করপুর বাসস্ট্যান্ডের ৩ কিমি এবং বাস স্ট্যান্ড থেকে জলদা পর্যন্ত আরও ৩ কিমি অংশে। এখানে ঢেউ উঠেছিল সাড়ে তিন মিটার। ৩) যে পদ্ধতিতে নির্মাণ হওয়ার কথা, তাতে এত বড় বিপত্তি হওয়াটা বেশ আশ্চর্যের। যে প্রকৌশল সেখানে ব্যবহার হয়েছিল বলে দাবি, তাতে গোটা নির্মাণটি সামুদ্রিক ঝঞ্ঝা-বিপর্যয়ে এতটা কাবু হওয়ার কথা নয়। তাই এই সব অংশের নির্মাণের জন্য যে যে উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে, তা সংগ্রহ করে ল্যাব টেস্টের জন্য পাঠানো হয়েছে। নির্মাণকারী টেন্ডারের শর্ত মেনে উপকরণ সরবরাহ করেছিল কি না, তা খতিয়ে দেখার জন্যই এই সিদ্ধান্ত।
এই সামুদ্রিক বাঁধ নির্মাণ (embankments) প্রকল্পের টেন্ডার কেন শুধু কাঁথি, বাজকুল, চণ্ডীপুর ও নন্দকুমারের বাসিন্দা (মাঝেমধ্যে ঝাড়গ্রামের একজন) ঠিকাদারের মধ্যেই আবর্তিত হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এর মধ্যে যাত্রানালা, ফোরশোর রোড, শঙ্করপুর মেরিন ড্রাইভ রোড, তাজপুর সহ বিভিন্ন এলাকার নির্মাণ গত মার্চ মাসে ডিএসডিএ-র ডাকা টেন্ডারের ভিত্তিতে তৈরি হয়। সেগুলি কেন ধূলিসাৎ হল, তদন্তে দেখা হচ্ছে তাও। রামনগরের বিধায়ক তথা মৎস্যমন্ত্রী অখিল গিরি সরাসরি জানাচ্ছেন, ‘পেটোয়া ঠিকাদারদের সামনে রেখে চরম দুর্নীতি হয়েছে বাঁধ নির্মাণে। তদন্ত করে দোষীদের শাস্তি দেওয়া হোক।’