প্লেসমেন্টে চাকরি দেওয়ার দৌড়ে দেশের শীর্ষে বাংলা
বাংলার ছেলেমেয়েদের হাতে নাকি চাকরি নেই। সদ্য সমাপ্ত বিধানসভা ভোটের আগে এটাও ছিল কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপির (BJP) অন্যতম প্রচার। কিন্তু সেই কেন্দ্রের সংস্থার দেওয়া তথ্য বলছে, এগিয়ে বাংলাই (West Bengal)। পিছিয়ে প্রধানমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রাজ্য গুজরাট-সহ বিজেপি শাসিত আরও অনেক রাজ্য। এমনকী এই সুরে সুর মেলানো সিপিএমের একমাত্র ‘মডেল স্টেট’ কেরালাকেও এই নিরিখে পিছনে ফেলে দিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) নেতৃত্বাধীন পশ্চিমবঙ্গ।
দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানেজমেন্ট-সহ পেশাগত নানা কোর্স চলে এমন প্রতিষ্ঠানগুলির নিয়ামক সংস্থা হল অল ইন্ডিয়া কাউন্সিল ফর টেকনিক্যাল এডুকেশন বা এআইসিটিই। তারা দেশজুড়ে সমীক্ষা চালিয়ে গত শিক্ষাবর্ষ অর্থাৎ ২০১৯-২০২০ সালে পাশ করা পড়ুয়াদের হাতে কোন রাজ্য কত চাকরি তুলে দিতে পেরেছে তার হিসেব প্রকাশ করেছে। ইঞ্জিনিয়ারিং বা ম্যানেজমেন্টের পড়াশোনা করার পর সবারই নজর থাকে একটি চাকরির। সেই নিরিখে বাংলা পিছনে ফেলে দিয়েছে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, কেরালা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র এমনকী কর্নাটককেও। বিজেপি শাসিত কর্নাটকে যেখানে মোট ছাত্রসংখ্যার ৩৮ শতাংশের হাতে চাকরি তুলে দেওয়া গিয়েছে, সেখানে বাংলায় পাশ করার পর চাকরির জন্য এনরোলমেন্ট করা প্রায় ৫০ শতাংশ পড়ুয়া চাকরির অফার লেটার হাতে পেয়ে কাজ শুরু করেছেন। গুজরাটে এই হার মাত্র ২৮ শতাংশ, উত্তরপ্রদেশ মাত্র ৩৫ শতাংশ।
২০১৯-২০২০ বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা অবশ্য পুরোপুরি অতিমারী কালে পড়াশোনা করেছেন এমন নয়। তবে ২০২০, মার্চের পর থেকে তাঁদের অন্তিম সেমেস্টার পড়েছিল সেই সময়ে, যখন দেশজুড়ে চলছে লকডাউন। তখন এই পড়ুয়াদের পরীক্ষা কী ভাবে হবে, তা নিয়ে কম কাটাছেঁড়া হয়নি। এমনকী শেষ দিকে প্লেসমেন্ট প্রক্রিয়াও থমকে যায় এই লকডাউনের কারণে। আগে যাঁরা চাকরির অফার লেটার পেয়েছিলেন, সেই পড়ুয়াদের নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল আদৌ তাঁদের চাকরি থাকবে কি না এই প্রশ্নে। কিন্তু তথ্য বলছে, এই কঠিন সময়েও প্লেসমেন্টের নিরিখে বাংলা এগিয়ে রয়েছে। প্লেসমেন্টের নিরিখে বাংলার থেকে এগিয়ে আছে যে দু’টি রাজ্য তার একটি হলো তামিলনাড়ু, অন্যটি দিল্লি। দিল্লিতে যদিও মোট ছাত্রসংখ্যা পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অনেক কম।
কম ছাত্রসংখ্যার নিরিখে উল্লেখযোগ্য হল ত্রিপুরা। যেখানে সর্বমোট ছাত্র সংখ্যা মাত্র ১৩৯৯। সেখানেও মাত্র ১৮৮ জনের হাতে চাকরি তুলে দেওয়া গিয়েছে। ঘটনাচক্রে ত্রিপুরাতেও রয়েছে বিজেপি সরকার। প্রতিবেশী রাজ্য বিহার, ওডিশার থেকেও বাংলা অনেক এগিয়ে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ উপাচার্য চিরঞ্জীব ভট্টাচার্যর বক্তব্য, ‘আমি বহু বছর ধরেই দেখছি বাংলার ছাত্রছাত্রীদের নিয়োগের জন্য শিল্প সংস্থাগুলি মুখিয়ে থাকে। বাংলার পড়ুয়ারাও চাকরি ক্ষেত্রে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় ভালো পারফর্ম করেন। এই কারণেই এ রাজ্যের ছেলেমেয়েদের এত ভালো ফলাফল হয়েছে। যেটা আমরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি হিসেব কষতে গিয়েও দেখেছি।’
রাজ্যের বেশির ভাগ ইঞ্জিনিয়ারিং ও ম্যানেজমেন্ট কলেজ মৌলনা আবুল কালাম আজাদ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যাল বা ম্যাকাউটের অধীনে। উপাচার্য সৈকত মৈত্র বলছেন, ‘আধুনিক মানের সিলেবাস, কর্মমুখী কোর্স এবং পড়ুয়াদের মনোযোগের পাশাপাশি আমরা সব সময় খেয়াল রেখেছি যাতে কলেজগুলি শিল্প সংস্থার সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরি করে। বাংলা অনেক আগে এই ভাবে ভেবেছে বলেই পরে জাতীয় স্তরে সেই মডেল গ্রহণ করা হয়। তাতেই সাফল্য ঘরে এসেছে।’ এ ক্ষেত্রে অবশ্য অনেকেই মনে করিয়ে দিচ্ছেন, যখন সারা দেশ জুড়ে লকডাউনের পর পড়াশোনা কী ভাবে চলবে তা নিয়ে আলোচনা চলছে, তখনও কিন্তু ম্যাকাউট অনলাইনে পড়াশোনা শুরু করে দিতে পেরেছিল। রাজ্যের বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজগুলির সংস্থা আপাইয়ের সভাপতি তরণজিৎ সিংয়ের সংযোজন, ‘কর্মমুখী কোর্স তৈরি করে পড়ুয়াদের পেশাগত ক্ষেত্রে ক্রমশ অভিজ্ঞ করে তোলার একটি প্রচেষ্টা গত কয়েক বছরে চলেছে। যাতে বাংলার ছেলেমেয়েদের চাকরির ক্ষেত্রে গিয়ে বসে থাকতে না হয়। পাশাপাশি ইন্টারভিউয়ের জন্য তাঁদের কমিউনিকেশন স্কিলও কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়স্তর থেকেই তৈরি করা হয়েছে।’ তরণজিৎ মনে করছেন, এর সম্মিলিত ফসল তুলতে পেরেছে পশ্চিমবঙ্গ।