কলকাতা বিভাগে ফিরে যান

ভুয়ো টিকা: দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা রুজু করতে নির্দেশ মমতার

June 26, 2021 | 3 min read

ভুয়ো ভ্যাকসিন শিবিরের আয়োজক দেবাঞ্জন দেবের বিরুদ্ধে অনিচ্ছাকৃত খুনের মামলা রুজু করতে পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

কসবার ওই শিবির এবং তার পরের ঘটনাক্রম নিয়ে তিনি এতটাই ক্ষুব্ধ যে দেবাঞ্জনকে ‘রাস্তায় দাঁড় করিয়ে পাঁচ হাজার বার ওঠবোস’ করানো উচিত বলেও এ দিন কথাচ্ছলে ঘনিষ্ঠ মহলে মন্তব্য করেছেন মমতা।

সূত্রের খবর, কসবার ওই ভুয়ো শিবির নিয়ে শুক্রবার পুলিশ কমিশনার সৌমেন মিত্রের সঙ্গে বহু বার কথা বলেন মুখ্যমন্ত্রী। কমিশনারকে তাঁর নির্দেশ, এই ঘটনায় এমন দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এই ধরনের অপরাধ করার আগে মানুষ ১০০ বার ভাবে। দেবাঞ্জনের ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশ যেন আপস না করে বা সহানুভূতি না দেখায়, তার দিকেও নজর দিতে বলেছেন মমতা। কসবার ঘটনায় বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অনুমান করছে পুলিশ। যার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে পুরসভার নিচুতলার কয়েক জন। কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা প্রধান মুরলীধর শর্মা জানিয়েছেন, সেই ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করতে ডিসিডিডি সৈকত ঘোষের নেতৃত্বে বিশেষ তদন্তকারী দল বা সিট গঠন করছে লালবাজার।

মুখ্যমন্ত্রীর আরও নির্দেশ, সে দিন কসবার ওই ভুয়ো ক্যাম্পে যাঁরা প্রতিষেধক নিয়েছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে আলাদা চিহ্নিত করতে হবে। প্রত্যেকের আলাদা ভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার জন্য তিনি রাজ্যের স্বাস্থ্য সচিব নারায়ণ স্বরূপ নিগমকেও নির্দেশ দিয়েছেন। মমতার নির্দেশ, স্বাস্থ্য পরীক্ষার পরে কারও চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তা নিশ্চিত করে করাতে হবে। চার জন চিকিৎসককে নিয়ে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিও গঠন করা হয়েছে।

সূত্রের খবর, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই এ দিন বাগরি মার্কেটে অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযোগ, কসবার ক্যাম্পের জন্য হেয়ার স্ট্রিট থানা এলাকার এই বাগরি মার্কেট থেকেই নাকি দেবাঞ্জন প্রতিষেধক কিনে নিয়ে গিয়েছিল। পুলিশের দাবি, আসল বা নকল কোনও করোনা প্রতিষেধকই বাগরিতে পাওয়া যায়নি। সরকারের কাছে যে প্রতিষেধক জমা রয়েছে, তবে কি সেখান থেকে কোনও ভাবে প্রতিষেধক পেয়েছিলেন দেবাঞ্জন। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এ দিন সরকারের কাছে থাকা প্রতিষেধকের সমস্ত স্টক পরীক্ষা করা হয়েছে। সেই স্টক মিলে গিয়েছে বলেও সূত্রের খবর। সূত্রের খবর, ক্যানিং স্ট্রিটের মেহতা বিল্ডিংয়ের এক ব্যবসায়ীর থেকে অ্যামিকাসিন অ্যান্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন কিনে তা করোনা প্রতিষেধক বলে চালিয়েছিল দেবাঞ্জন। ধৃতের অফিস থেকে ওই রসিদইও মিলেছে।

শুক্রবার দেবাঞ্জনের মুখোমুখি বসিয়ে তার পরিচিত চার জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। যাঁর দোকানে ভুয়ো করোনা প্রতিষেধকের মোড়ক বানিয়েছিল দেবাঞ্জন, তিনিও ওই চার জনের অন্যতম। পুলিশের অভিযোগ, পুরসভার অফিসারদের সই জাল করে ভুয়ো পরিচয়পত্র ছাড়াও ভুয়ো নথি দিয়ে দেবাঞ্জন কলকাতার তিনটি ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খুলেছিল। একটি অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল কলকাতা পুরসভার নামে। পুলিশের দাবি, সেই অ্যাকাউন্ট খোলার ক্ষেত্রে ওই প্রতারক পুরসভার দু’জন আধিকারিকের নাম ব্যবহার করেছিল। এ দিনই দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে ওই জালিয়াতির জন্য নিউ মার্কেট থানায় আরও দু’টি মামলা রুজু হয়েছে। গোয়েন্দাদের দাবি, এর মধ্যে একটি অ্যাকাউন্ট দেবাঞ্জনের নিজের নামে। বাকি দুটির একটি কারেন্ট অ্যাকাউন্ট। কোনওটিতেই বেশি টাকা নেই বলে লালবাজার সূত্রের খবর।

পুলিশ সূত্রের খবর, গত বছর লকডাউনের সময়ে দেবাঞ্জন সমাজসেবী হিসেবে মাস্ক, স্যানিটাইজার, পিপিই কিটের ব্যবসা শুরু করেছিল। যার থেকে লভ্যাংশ সে বিভিন্ন ক্লাব, থানা এবং সংগঠনে দান করত। এই করতে গিয়ে পুরসভার বিভিন্ন কর্মী, অফিসার থেকে শুরু করে বিভিন্ন নেতা এবং পুলিশের সঙ্গে তার যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল বলে সে জেরায় দাবি করেছে। লালবাজারের এক কর্তা জানান, বিভিন্ন পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে দেবাঞ্জনকে ছবিতে দেখা যাচ্ছে। ওই অফিসারদের সঙ্গে কী ধরনের সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল দেবাঞ্জনের, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

লালবাজার জানিয়েছে, পুরসভার যুগ্ম কমিশনার পরিচয়ে বিভিন্ন ঠিকাদারের সঙ্গে আলাপ জমিয়ে তাঁদের কাজের বরাত পাইয়ে দিয়ে নিজে সাব ঠিকাদার হিসেবে কাজ করবে বলে তাঁদের জানিয়েছিল। অভিযোগ, ঠিকাদারদের ঠকিয়ে তাঁদের কাছ থেকে টাকা হাতানোর অভিযোগ উঠেছে দেবাঞ্জনের বিরুদ্ধে। প্রশ্ন উঠেছে, এই বরাত-ই বা সে কী ভাবে পাইয়ে দিয়েছিল।

তদন্তকারীরা জানান, ধৃত নিজের সংস্থার কর্মীদেরও ভুয়ো প্রতিষেধক দিয়েছিল। পুলিশের দাবি, সোনারপুরের এক নেতার অনুরোধে কসবায় গত ১১ জুন প্রথম শিবির করে সে। এর পর চার দফায় ওই শিবির সেখানে হয়েছে। মোট ৫১৫ জনকে ওই শিবির থেকে প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছে। অন্য দিকে সিটি কলেজ থেকে ৭২ জনকে প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছে।

কেন তিনি প্রতিষেধক শিবিরের আয়োজন করছিলেন, তা নিয়েও শুরু হয়েছে নানা জল্পনা। তদন্তকারীদের একাংশের মতে, আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে শাসকদলের প্রার্থী হওয়াই ছিল দেবাঞ্জনের লক্ষ্য। সেই কারণে বিভিন্ন সমাজসেবা মূলক কাজ করে নিজের পরিচিতি বাড়াতে চেয়েছিল। উঠে এসেছে আরও একটি নাম। নেপথ্যে থাকা সেই ব্যক্তিই নাকি প্রার্থী হতে চান এবং তিনি দেবাঞ্জনের মাধ্যমে ওই সব সমাজসেবা মূলক কাজ করতে চাইছিলেন।

অভিযোগ, নিজেকে কলকাতা পুরসভার জয়েন্ট কমিশনার পরিচয় দিয়ে নেতা-মন্ত্রীদের কাছে বিনামূল্যে মাস্ক ও স্যানিটাইজার পৌঁছে দিয়ে তাঁদের ঘনিষ্ঠ হত সে। অভিযোগ, ওই একই পরিচয় দিয়ে যুবক-যুবতীদের চাকরি দেওয়ার নাম করে প্রায় ৭০ টাকা লক্ষ টাকা আত্মসাৎ-ও করেছিল। আর ওই টাকা দিয়েই স্যানিটাইজার ও মাস্ক কিনে তা বিলি করছিল। তদন্তকারীদের দাবি, পুর কর্তাদের একাংশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের সুবাদে বিভিন্ন দফতরের অফিসারদের উপরেও প্রভাব ছিল তার এবং সেই সুযোগেই পুরসভার বিভিন্ন লোগো, স্টাম্প এবং প্যাড কৌশলে হাতিয়ে নিজের অফিস ও বিভিন্ন শিবিরে দেবাঞ্জন ব্যবহার করত।

বাগরি মার্কেট থেকে ভুয়ো ওষুধের ভায়াল কিনে তার উপর কখনও কোভিশিল্ড তো কখনও স্পুটনিক প্রতিষেধকের স্টিকার সাঁটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল দেবাঞ্জন। পুলিশ জানিয়েছে, ওই প্রতিষেধক দেওয়ার জন্য দু’জন কমপাউন্ডারকে নিয়োগ করা হয়েছিল। সপ্তাহে সাত হাজার টাকা করে ওই দু’জনকে দেওয়া হত। ওই দু’জন কম্পাউন্ডারের খোঁজ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। দেবাঞ্জনের সঙ্গে কোনও দফতরের যোগসূত্র রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখতে শুক্রবার কলকাতা পুর কমিশনারের তরফে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তদন্ত শুরু করছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরও। কসবা ও সিটি কলেজের ওই ভুয়ো শিবিরে যাঁরা ভ্যাকসিন নিয়েছিলেন, আজ শনিবার ওই দুই এলাকায় শিবির করে তাঁদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করবে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Fake vaccine, #debanjan deb, #Mamata Banerjee

আরো দেখুন