ওয়েলসকে হারিয়ে ইউরোর কোয়ার্টার ফাইনালে ডেনমার্ক
১৯৯২ সালের ২৬ জুন সুইডেনের মাঠে রূপকথা লিখেছিল ডেনমার্ক। সেদিনের আন্ডারডগরা ইউরোপসেরা হয়েছিল সবাইকে চমকে দিয়ে। ২৯ বছর বাদের আরেক ২৬ জুনও কম উল্লেখযোগ্য নয় ডেনমার্কের ফুটবলে। আজ, শনিবার ইউরো কাপের (Euro 2020) প্রি কোয়ার্টার ফাইনালে ওয়েলসকে ০-৪ গোলে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে গেল ‘ড্যানিশ ডিনামাইট’রা। গ্যারেথ বেলের দৌড় থেমে গেল ইউরোয়। তাঁর মঞ্চে উজ্জ্বল ক্যাসপার ডলবার্গ। ডেনমার্কের হয়ে বাকি দু’টি গোল করেন জোয়াকিম ও ব্র্যাথওয়েট।
সেবার অর্থাৎ ১৯৯২ সালে ইউরো শুরু হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে উয়েফার কাছ থেকে চিঠি পেয়েছিল ডেনমার্ক (Denmark)। সেই চিঠির বিষয়বস্তু ছিল, মূলপর্বে খেলার জন্য দল ঘোষণা করুক ডেনমার্ক। উয়েফার সেই চিঠি পেয়ে বিস্মিত হয়ে গিয়েছিল ডেনমার্ক ফুটবল ফেডারেশন। কারণ বাছাই পর্বে দ্বিতীয় হয়েছিল ড্যানিশরা। আর তার ফলেই মূলপর্বের দরজা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাদের জন্য। গ্রুপে প্রথম হয়েছিল তদানীন্তন যুগোস্লাভিয়া। গ্রুপে শীর্ষস্থান দখল করলেও যুগোস্লাভিয়ার পক্ষে ইউরোতে যাওয়া আর সম্ভব হয়নি। কারণ মূলপর্বের আগেই গৃহযুদ্ধে ভেঙে যায় যুগোস্লাভিয়া। নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয় সেদেশের উপরে। ফলে ফিফা ও উয়েফাও সব টুর্নামেন্টে নিষিদ্ধ করে যুগোস্লাভিয়াকে। সেই সুযোগে গ্রুপে দ্বিতীয় স্থান পাওয়া ডেনমার্কের জন্য দরজা খুলে যায়। আর টুর্নামেন্টে নেমে ডেনমার্ক ফুল ফোটায়। চ্যাম্পিয়ন হয়ে তবেই থামে।
এবার অবশ্য সেরকম কিছু হয়নি। নরওয়ের কোচ হারেইদের কোচিংয়ে দারুণ প্রস্তুতি নিয়েছিল ডেনমার্ক। তাঁর কোচিংয়ে টানা চব্বিশ ম্যাচ অপরাজিত ছিল এরিকসনের দেশ। কিন্তু হারেইদের সঙ্গে চুক্তি আর বাড়ায়নি ডেনমার্ক ফুটবল সংস্থা। কোচের রিমোট কন্ট্রোল তুলে দেওয়া হয় ক্যাসপার হিউলমান্দের হাতে। তাঁর কোচিংয়ে ২৩ ম্যাচের মধ্যে মাত্র দু’টিতে হারে ডেনমার্ক।
টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই এরিকসনের ঘটনা ডেনমার্ককে জোরাল ধাক্কা দিয়েছিল। প্রথম ম্যাচেই ফিনল্যান্ডের কাছে মুখ থুবড়ে পড়েছিল তারা। কিন্তু তার পরে টুর্নামেন্ট যত এগোয়, ডেনমার্কও রং ছড়ায়। এর নেপথ্যে রয়েছেন হিউলমান্দ। দলটাকে এককাট্টা করেন তিনি। ছেলেদের থেকে সেরাটা বের করে নেন। সেই কারণেই ডেনমার্ককে এখন এত উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। এদিন যেমন ওয়েলস তারকা গ্যারেথ বেলের (Gareth Bale) দৌড় থামিয়ে দিলেন ড্যানিশরা। জোহান ক্রয়েফ এরিনা থেকে মাথা নীচু করে মাঠ ছাড়তে হল বেলকে। অথচ কোপা দেল রে-তে আগুন জ্বালানো বেলের সেই দৌড় এখনও উজ্জ্বল ফুটবলপ্রেমীদের মনে। এদিন সেরকম দৌড় দেখা গেল না বেলের কাছ থেকে।
ম্যাচের শুরুতে অবশ্য বেলের বাঁ পা দেখে অনেকেই মনে করেছিলেন দিনটা বুঝি তাঁর। কিন্তু দিনের শুরু দেখে সব সময়ে বোঝা যায় না গোটা দিনটা কেমন যাবে। ২৭ মিনিটে ক্যাসপার বক্সের বাইরে থেকে বাঁক খাওয়ানো শটে ওয়েলসের জাল কাঁপান। ডেনমার্কই এবারের ইউরোয় একমাত্র দেশ যারা বক্সের বাইরে থেকে শটে বেশি গোল করেছে। ক্যাসপারও এদিন তাই করলেন। ওয়েলসের গোলকিপার ড্যানি ওয়ার্ড শরীর ছুড়ে দিলেন। কিন্তু বল তাঁর নাগাল এড়িয়ে জড়িয়ে যায় ওয়েলসের জালে।
এরিকসনকে বুকে নিয়ে প্রি কোয়ার্টারে নেমেছিলেন ডিলেইনি-লারসেনরা। ১২ ঘন্টার জন্য নেদারল্যান্ডসে এসে খেলা দেখার ছাড়পত্র পেয়েছিলেন ড্যানিশ সমর্থকরা। সমর্থকদের হতাশ করেননি ক্যাসপাররা। দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই ব্যবধান বাড়ান ক্যাসপার। আক্রমণের তীব্রতা আরও বাড়ায় ডেনমার্ক। ম্যাচের রাশ নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় ড্যানিশরা। ওয়েলসের পক্ষে ম্যাচে ফেরা আর সম্ভব হয়নি। যদিও সবাই ধরেই নিয়েছিলেন দ্বিতীয়ার্ধে জ্বলে উঠবে ওয়েলস। কিন্তু তাদের সমর্থকরা নিরাশ হন। খেলার ৮৮ মিনিটে ব্যবধান আরও বাড়ান জোয়াকিম। তার কিছুক্ষণ বাদেই ব্র্যাথওয়েট শেষ পেরেকটি পুঁতে দেন ওয়েলসের কফিনে। ততক্ষণে অবশ্য ওয়েলস ম্যাচ থেকে হারিয়ে গিয়েছে। আক্রমণ, আক্রমণ আর আক্রমণ- এই মন্ত্রেই ওয়েলসকে উড়িয়ে দিল ডেনমার্ক।
ইউরো আর ডেনমার্ক মানেই যেন মন খারাপ করা গল্প। এবার শুরুতেই এরিকসনের ঘটনা। ২৯ বছর আগের ইউরোয় সেমিফাইনাল ও ফাইনালের নায়ক ছিলেন কিম ভিলফোর্ট। তাঁর ৭ বছরের মেয়ে লিন ভিলফোর্ট লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত ছিল। টুর্নামেন্ট চলাকালীন ভিলফোর্ট দেশে ফিরে গিয়েছিলেন মেয়েকে দেখতে। মেয়ের জন্য ইউরো কাপ ট্রফি নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন ভিলফোর্ট। কিন্তু বাঁচানো যায়নি সাত বছরের মেয়েকে। ডেনমার্ক ইউরোপসেরা হওয়ার দিনকয়েক পরেই মারা গিয়েছিল ভিলফোর্টের মেয়ে।
এরিকসন এখন আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ। নিজে মাঠে নামতে না পারলেও সতীর্থদের খেলা দেখছেন নিশ্চয়। তাঁর পাশে গোটা দেশ। সতীর্থরাও তাঁর জন্যই ট্রফি জিততে মরিয়া। ওয়েম্বলির ফাইনালে কি ড্যানিশরা ১৯৯২ সালের মতো রূপকথা লিখতে পারবেন? ইতিমধ্যেই স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দিয়েছেন ডেনমার্কের সমর্থকরা।