ইজরায়েলের পেগাসাস সফ্টওয়ারের মাধ্যমে ভারতের ৪০ জন সাংবাদিকের ওপর নজরদারি, প্রকাশ্যে এল বিস্ফোরক তথ্য
ভারতের ৪০ জন সাংবাদিকের (Journalist) ফোন হ্যাক করেছে ইজরায়েলি স্পাইওয়্যার সংস্থা পেগাসাস (Pegasus)। দ্য ওয়্যার-এর রিপোর্ট তেমনই দাবি করছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, দ্য হিন্দুস্তান টাইমস, ইন্ডিয়া টুডে, নেটওয়ার্ক ১৮, দ্য হিন্দু এবং ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-সহ বেশ কিছু বড় সাংবাদমাধ্যমের শীর্ষ স্তরের সাংবাদিকদের ফোন হ্যাক করা হয়েছে। ফোন হ্যাকিংয়ের তালিকায় মন্ত্রী এবং সাংবাদিক ছাড়াও রয়েছেন বহু ব্যবসায়ী, সরকারি আধিকারিক, বিজ্ঞানী এবং সমাজকর্মী। দ্য ওয়্যার-এর তথ্য বলছে, বেশির ভাগ হ্যাক করা হয়েছে ২০১৮ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে।
দ্য ওয়্যার-এর রিপোর্টে আরও দাবি করা হয়েছে, হ্যাকিংয়ের তালিকায় রয়েছে ৪০ জনেরও বেশি সাংবাদিক। ৩ জন বিরোধী নেতা। মোদী মন্ত্রিসভার দুই মন্ত্রী। দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর বর্তমান এবং প্রাক্তন প্রধান এবং বহু ব্যবসায়ী।
২০১৯ সালের পর ফের খবরের শিরোনামে উঠে আসে ইজরায়েলের সফটওয়্যার পেগাসাস। রবিবার সকালেই বিজেপি-র রাজ্যসভার সাংসদ সুব্রহ্মণ্যম স্বামী অভিযোগ তোলেন, পেগাসাস আড়ি পাতছে দেশের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের ফোনে। পাশাপাশি, আড়ি পাতা হচ্ছে মোদীর মন্ত্রিসভার সদস্যদের ফোনে এবং আরএসএস নেতাদের ফোনেও। তিনি লেখেন, এই বিষয়ে একটি রিপোর্টও নাকি শীঘ্রই প্রকাশ পাবে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে। যদিও গোটা বিষয়টিকেই একটি ‘শক্তিশালী গুজব’ বলে উল্লেখ করেছেন স্বামী।
বিস্ফোরক এই দাবি করে রবিবার সকালে টুইটে স্বামী লেখেন, কাদের ফোনে আড়ি পাতা হচ্ছে, সেই তালিকা বিস্তারিত পেলেই তিনি প্রকাশ করবেন। সেই টুইটের পাল্টা উত্তর দেন তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েন। তিনি ওই আড়িপাতার তালিকায় শুধু যুক্ত করে দেন, ‘‘…অনেক বিরোধী দলের সদস্যও’’। অর্থাৎ, বিরোধী দলের সদস্যদের ফোনেও আড়ি পাতা হচ্ছে বলে তাঁর অভিযোগ।
টুইট করেন পি চিদম্বরমের পুত্র কার্তি চিদম্বরমও। তিনিও পেগসাসের কথা উল্লেখ করেন। তবে স্বামীর মতো স্পষ্ট করে নয়। তিনি টুইটারে লেখেন, ‘…পেগাসাস বিস্ফোরণ ঘটাতে চলেছে।’ কোনও কোনও মহল থেকে আন্দাজ করে বলা হয়েছে, ভারতীয় সময় রবিবার রাত ১২টার পর এই বিষয়ে একাধিক পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হতে পারে। যদিও এখনও পর্যন্ত সবটাই জল্পনা।
২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে খবরের শিরোনামে আসে পেগাসাস। সেখানে বলা হয়, সারা পৃথিবীর প্রায় ১ হাজার ৪০০ জনের ফোনে আড়ি পাতা হয়েছিল। সেই তালিকায় ছিলেন কূটনীতিক, নেতা, সাংবাদিক ও সরকারি আধিকারিকরা। ভারতের ব্যবহারকারীরাও ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। সেই তালিকায় ছিলেন গবেষক, দলিত আন্দোলনকারী, সাংবাদিক। সেই সময়ে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেছিলেন, কেন্দ্রীয় সরকার পেগাসাসের কোনও অনৈতিক ব্যবহার করেনি।
পেগাসাস স্পাইওয়্যারের সম্ভাব্য ‘টার্গেট’ তালিকায় অন্তত ৪০ জন ভারতীয় সাংবাদিকের ফোন নম্বর রয়েছে। এবং ফরেন্সিক টেস্ট এটা নিশ্চিত করেছে যে এদের অনেকের ওপর নজরদারি চালাতে ওই সংস্থা সফল হয়েছে। এই তালিকায় নাম রয়েছে হিন্দুস্তান টাইমস, ইন্ডিয়া টুডে, নেটওয়ার্ক ১৮, দ্য হিন্দু, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মতো বড় বড় সংস্থার সাংবাদিকদের।
যদিও শুধু ফোন নম্বরের উপস্থিতে এটা বোঝা যাচ্ছে না যে তাঁদের ফোনকে হ্যাক করার চেষ্টা করা হয়েছিল নাকি ডিভাইসগুলি পেগাসাসে আক্রান্ত হয়েছিল। কিন্তু কিছু তদন্তের মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে নজরদারির স্বার্থেই ব্যবহার করা হয়েছিল তথ্য। এর মধ্যে ১০ টি নম্বরে পেগাসাস নজরদারি সফলও হয়েছে।
ইজরায়েলি সংস্থা এনএসও গ্রুপ এই পেগাসাস স্পাইওয়্যার তৈরি করেছে। বিশেষজ্ঞরা এটাকে সাইবার অস্ত্র বলে থাকেন। ২০১৬ সালে এটি প্রথম প্রকাশ্যে আসে। একটি মেসেজ পাওয়ার পর সন্দিহান হয়ে ওঠেন আরবের এক সমাজকর্মী। তার পরই সামনে আসে পেগাসাসের কথা। সম্ভবত এই স্পাইওয়্যার এখনও পর্যন্ত সবথেকে আধুনিক ফোন হ্যাকিং টুল। এর পাশাপাশি এনএসও গ্রুপও পেগাসাসের অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে নিয়েছে। যদিও সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে, শুধুমাত্র সরকারকেই এই টুল বিক্রি করা হয়। এর অপব্যবহারের জন্য সংস্থা দায়ী নয়।
সংস্থাটি শুরুতে কাদের ওপর নজরদারি চালানো হয় সেই তালিকা দিতে অস্বীকার করলেও, ফ্রান্সের সংবাদ মাধ্যম দ্য ফরবিটেন স্টোরি এবং অ্যামেন্সটি ইন্টারন্যাশনাল প্রথম এই তালিকার হদিশ পায় এবং তারা দ্য ওয়্যার, দ্য গার্ডিয়ানের মতো বিশ্বব্যাপী মোট ১৬ টি সংস্থার হাতে সেই তালিকা তুলে দেয়।
দ্য ওয়্যারের দুজন প্রতিষ্ঠাতার একজন রোহিণী সিং- এর নম্বরও এই তালিকায় রয়েছে। অমিত শাহের ছেলে জয় শাহ, নরেন্দ্র মোদী ঘনিষ্ঠ নিখিল মার্চেন্ট এবং পীয়ুষ গোয়েলের বিরুদ্ধে একের পর এক খবর প্রকাশের পরেই তার নম্বর ওই স্পাইওয়্যারে যোগ করা হয়।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক সুশান্ত সিং রাফায়েল দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত ও খবর করার পর ২০১৮- তে তাঁর নম্বর ওই তালিকায় আসে। এবছরের শুরুতেই সুশান্তের ফোনে পেগাসাস আক্রমণের লক্ষন দেখতে পাওয়া যায়।
১০ টি দেশের মোট ১৫৭১ টি ফোনে পেগাসাস আক্রমণের লক্ষন দেখা গেছে।
একবার কোনও একটা ফোনকে শনাক্ত করে নিলে হ্যাকার একটা ওয়েবসাইট লিঙ্ক পাঠায়। ব্যবহারকারী তাতে ক্লিক করলেই ফোনে পেগাসাস ইনস্টল হয়ে যায়। হোয়াটসঅ্যাপের মতো অ্যাপে ভয়েস কলের সিকিউরিটি বাগের মাধ্যমেও এটা ইনস্টল হতে পারে। এতটাই গোপনে বিষয়টি হয় যে, ব্যবহারকারীকে একটি মিস কল দিয়েই পেগাসাস ইনস্টল করে ফেলা যায়। একবার ইনস্টল হওয়ার পর সব কল লগ এন্ট্রি মুছে ফেলে এই সফ্টওয়্যার।
এক বছর পর নিরাপত্তা সংক্রান্ত গবেষকরা লক্ষ্য করেন, পেগাসাস একইভাবে অ্যান্ড্রয়েড ফোনকেও হ্যাক করতে পারে। এর পর পেগাসাস তৈরি করার জন্য ২০১৯ সালে এনএসও গ্রুপের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করে ফেসবুক। এর পাশাপাশি ফেসবুকের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা পেগাসাসের গতিবিধির দিকে নজর রাখছিলেন। তাঁরা দেখেন, ভারতের বিভিন্ন সাংবাদিক ও সমাজকর্মীর ক্ষেত্রে এই সফ্টওয়্যার ব্যবহার করা হয়েছে। এই সময়েই একটি মেসেজের মাধ্যমে ‘আক্রান্ত’ ব্যবহারকারীদের বিষয়টি নজরে আনে হোয়াটসঅ্যাপ।
যেসব সাংবাদিকদের নম্বর তালিকায় রয়েছে তারা সবাই প্রায় দিল্লির এবং বড় বড় প্রতিষ্ঠানের হয়ে সাংবাদিকতা করেন। যেমন হিন্দুস্তান টাইমসের সম্পাদক শিশির গুপ্ত, ব্যুরো চিফ, প্রশান্ত ঝা, সাংবাদিক রাহুল সিং। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিতিকা চোপড়া, মুজাম্মিল জামিল (যে কাশ্মীর সম্পর্কে লিখেছিলেন)। এছাড়াও প্রতিটি বড় সংবাদ মাধ্যম থেকেই অন্তত একজন করে সাংবাদিকে নম্বর রয়েছে ওই তালিকায়। সব থেকে মজার বিষয় হল এই সব সাংবাদিকই কোন না কোন সময় বিজেপি বিরোধী বড় খবর ফাঁস করেছে।
বেশ কিছু সাংবাদিক যারা মূল স্রোতের সাংবাদিকতা ছেড়ে দিয়েছেন তাঁদের নম্বরও পাওয়া গেছে ওই তালিকায়। যেমন সৈকত দত্ত, প্রাঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা, স্মিতা শর্মা, ইফতিখার গিলানি। এই সবাইকেই ২০১৮- ২০১৯ –এর মধ্যে টার্গেট করা হয়েছে।