চেতলার টুর্নামেন্ট থেকেই সাফল্যের শুরু লাভলিনার
মেয়ের আবদারে বাবা একদিন বাড়ি ফিরল মিষ্টি নিয়ে। যা খবরের কাগজে মোড়া। মিষ্টি খাওয়ার আগেই হঠাৎ মেয়েটির চোখ পড়ল ঠোঙায়। ছবি ও লেখায় জ্বলজ্বল করছেন কিংবদন্তি মহম্মদ আলি। ব্যাস, বক্সিং-আগ্রহের পথ চলা শুরু তার। শান্ত ব্রহ্মপুত্রে সাফল্যের ঢেউ তুলতে তুলতে জীবনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া। শুক্রবার ওলিম্পিক (Olympics) বক্সিংয়ে (Boxing) সেই মেয়েটাই পদক নিশ্চিত করল। দেশবাসীকে এনে দিল গর্বিত হওয়ার সুযোগ। লাভলিনা বড়গোঁহাই (Lovlina Boroghain)। গুয়াহাটি থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরে গোলাঘাট জেলার বড়মুখিয়া গ্রামে মেরেকেটে দু’হাজার মানুষের বাস। লাভলিনার সৌজন্যে আজ সেই গ্রামকেই গুগল ম্যাপে খুঁজছে গোটা বিশ্ব।
খেলাধুলার চল ছিল বাড়িতে। দুই যমজ দিদি লিচা আর লিমাকে দেখেই ‘মুয়াই থাই’ বা কিক বক্সিংয়ে আসা লাভলিনার। কিন্তু এই খেলায় কিছুতেই তাঁর মন বসছিল না। বড়পাথার গার্লস স্কুলে পড়ার সময় স্পোর্টস অথরিটি অব ইন্ডিয়ার (সাই) ট্রায়াল হয়েছিল। গুয়াহাটি সাই কেন্দ্রের বক্সিং কোচ পাদুম চন্দ্র বোড়ো সেখান থেকেই খুঁজে বের করেন লাভলিনাকে। নিয়ে আসেন সাইতে। আজ সেই মেয়েটিই ওলিম্পিকসের আসরে ভারতের অন্যতম মুখ। মেয়েদের ৬৯ কিলোগ্রাম বিভাগের কোয়ার্টার-ফাইনালে চাইনিজ তাইপের চেন নিয়েম-চিনকে ৪-১ ব্যবধানে হারিয়ে তিনি শেষ চারে। বক্সিংয়ের নিয়মানুসারে সেমি-ফাইনালে ওঠা মানেই ব্রোঞ্জ নিশ্চিত। কিন্তু লাভলিনাকে ঘিরে আরও বড় প্রত্যাশা দেশবাসীর।
‘এই পারফরম্যান্স ধরে রাখতে পারলে ও সোনা জিতবেই…’। মুঠোফোনের উল্টোদিক থেকে কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসছিল পাদুম বোড়োর। ছাত্রীর সাফল্যে তিনি আবেগতাড়িত। সেটাই তো স্বাভাবিক। খনি থেকে কাচ কাটা হীরে তো তিনিই তুলে এনেছেন।
স্মৃতির সরণি হাতড়ে পাদুম আবার বলতে শুরু করলেন, ‘উচ্চতা ওর বড় অ্যাডভান্টেজ। প্রচণ্ড সাহসীও। ২০১২ সালের জুনে ওকে গুয়াহাটির সাই কেন্দ্রে নিয়ে আসি। তবে কখনওই লাভলিনা প্রচারের আলোয় আসেনি। কিন্তু আমার বিশ্বাস ছিল, টোকিওতে ও কিছু করে দেখাবে। ওলিম্পিকে অংশ নিতে যাওয়ার আগে আমার কাছে এসে একদিন বলল, স্যার খুব টেনশন হচ্ছে। আশীর্বাদ করে ওকে বলেছিলাম, চাপ নিস না। তোকে পদক জিতেই দেশে ফিরতে হবে। ও কথা রেখেছে। আমাকে অনেকেই জিজ্ঞাসা করছেন, ওর সঙ্গে কথা হয়েছে কিনা। না, হয়নি। চেষ্টাও করিনি। আমি একজন কোচ। জানি এই মুহূর্তে ওর মনের কী অবস্থা। অন্যদিকে ওর নজর না দেওয়াই ভালো। তাতে ফোকাস নড়ে যেতে পারে। কারণ, শেষ চারের লড়াই আরও কঠিন।’
লাভলিনার সাফল্যের পথ চলা শুরু অবশ্য কলকাতার চেতলা থেকে। সালটা ২০১২। আবদুল হাকিম মেমোরিয়াল বক্সিং ক্লাব আয়োজন করেছিল জাতীয় সাব জুনিয়র প্রতিযোগিতা। সেই আসরে সোনা জিতে চমকে দিয়েছিলেন লাভলিনা। রাজ্যের মন্ত্রী ববি হাকিম আজও ভোলেননি বাবার নামাঙ্কিত সেই টুর্নামেন্টের কথা। লাভলিনার সাফল্যে তিনিও দারুণ উচ্ছ্বসিত ‘আমার বাবাও বক্সার ছিলেন। ওঁর নামেই চেতলায় বক্সিং টুর্নামেন্ট হয়। বছর নয়েক আগে সেখানেই মেয়েটিকে প্রথম দেখেছিলাম। দারুণ লড়ে সোনা জিতেছিল। সেই লাভলিনাই আজ দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। আমরা সবাই গর্বিত। ওকে আমন্ত্রণ জানাব চেতলায়। আবদুল হাকিম মেমোরিয়াল বক্সিং ক্লাবেই ওকে সংবর্ধনা দেব।’