২৪শের ভোটে জঙ্গলমহলে নিজেদের আসন ধরে রাখতে পারবে বিজেপি? উঠছে প্রশ্ন
উন্নয়ন তো কম হয়নি জঙ্গলমহলে। তবু ভোটবাক্সে কেন উপুড়হস্ত হল না বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর। উনিশের লোকসভা ভোটে এই প্রশ্নটাই ভাবিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেসকে৷ জঙ্গলমহলের উন্নয়ন সত্ত্বেও বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুরে জিতেছিল বিজেপি৷ তার ঠিক একবছর আগে ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত ভোটের ফল ইঙ্গিত দিয়েছিল হাসি ফিকে হচ্ছে জঙ্গলমহলের। তাই ঝাড়গ্রামের হাসি ফেরানোর ভার দলের মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)।
আর পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ার পর্যবেক্ষকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তৎকালীন যুব তৃণমূল সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় (Abhishek Banerjee)। শেষ পর্যন্ত বছরভর চেষ্টা করেও জঙ্গলমহলের ক্ষোভ প্রশমন করা যায়নি। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে মোদী-হাওয়ায় চুরমার হয়ে গিয়েছিল জঙ্গলমহলে জোড়াফুলের দূর্গ। তবে ঠিক দু বছর পর ফের জঙ্গলমহলে রমারমা ঘাসফুলের। বলতে গেলে খেলা পুরো ঘুরে গিয়েছে। তারমধ্যে একুশের ভোটে পর্যদুস্ত হওয়ার পর রাজ্য বিজেপি এখন অনেকটাই ছন্নছাড়া। উল্টে সাম্প্রতিক সময়ে বঙ্গভঙ্গের দাবি নিয়ে দলের মধ্যে তৈরি হয়েছে দ্বন্দ্ব। এই আবহে আড়াই বছর পর হতে চলা লোকসভা ভোটে জঙ্গলমহলে নিজেদের আসন বিজেপি ধরে রাখতে পারবে কিনা? তা নিয়ে এখন থেকেই প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়ে গিয়েছে।
জঙ্গলমহল এলাকায় পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর ও ঝাড়গ্রাম-এই চার জেলায় মোট বিধানসভা আসনের সংখ্যা ৪০। পুরুলিয়ায় ৯, বাঁকুড়ার ১২, পশ্চিম মেদিনীপুরে ১৫ ও ছয় বছর আগে পশ্চিম মেদিনীপুর ভেঙে তৈরি ঝাড়গ্রাম জেলায় ৪ টি বিধানসভা আসন রয়েছে। এই আসনগুলির অধিকাংশই আদিবাসী অধ্যুষিত। এই জঙ্গলমহল এলাকা ২০১১ সাল থেকে তৃণমূলের গড় বলেই পরিচিত ছিল। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনে এই অঞ্চলে পাঁচটির মধ্যে চারটিতেই জিতেছিল বিজেপি (BJP) । সবমিলিয়ে বিধানসভার ভিত্তিতে এই অঞ্চলের ৪০ টির মধ্যে ৩১ টিতে এগিয়ে গিয়েছিল বিজেপি। গত লোকসভা ভোটে বিজেপি যে ১৮টি আসন জিতেছিল তার বেশিরভাগটাই এসেছিল উত্তরবঙ্গের পাশাপাশি জঙ্গলমহল থেকে। একুশের ভোটেও জঙ্গলমহল মুখ ফেরাবে না আশা ছিল মোদী-শাহদের। কিন্তু ফল বেরনোর পর দেখা গেল ৪০ টির মধ্যে ২৫ টিতে জিতেছে তৃণমূল। আর তারপর থেকেই জঙ্গলমহলে শুরু হয়েছে বিজেপিতে ভাঙনের খেলা।
জঙ্গলমহলে ভাঙনের খেলা বিজেপিতে
চলতি মাসেই পুরুলিয়ার পঞ্চায়েত সমিতির দখল নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। একুশের বিধানসভা ভোটের পরেই জেলার অনেক গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির দখল বিজেপির হাত থেকে গেছে তৃণমূলের দিকে। জঙ্গলমহলের ৪ জেলায় প্রায় প্রতিদিনই দলবদলের খবর আসছে। সম্প্রতি পুরুলিয়া জেলা পরিষদের বিরোধী দলনেতা অজিত বাউড়ি-সহ গেরুয়া শিবিরের এক ঝাঁক নেতা দলবদলে তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন। ইতিমধ্যে ঝাড়গ্রামের নেদাবহড়া পঞ্চায়েত হাতছাড়া হয়েছে বিজেপির। গিয়েছে সাঁকরাইলের রোহিনী গ্রাম পঞ্চায়েতও। এবার বিজেপিতে ভাঙন ধরল পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনি ব্লকে। সোমবার শালবনির জয়পুরে বিজেপির মণ্ডল সভাপতি-সহ ৩০০ জন কর্মী দলে ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেস যোগদান করেন। তাঁরা দল ছাড়ায় শালবনি বিজেপিতে আরও বিরাট ফাটল ধরার সম্ভাবনা।
বাংলার রাজনীতি নিয়ে যখনই চর্চা হয় তখনই বারবার ঘুরে ফিরে আসে জঙ্গলমহলের নাম ৷ বাঁকুড়ার রানিবাঁধ, রাইপুর থেকে শুরু করে ঝাড়গ্রাম, লালগড়, বেলপাহাড়ি … একটা সময় ছিল যখন এসব জায়গার নাম শুনলে গায়ে কাঁটা দিত ৷ মাওবাদীদের মুক্তাঞ্চল ছিল এইসব এলাকা ৷ গামছা দিয়ে মুখ ঢাকা, কাঁধে বন্দুকধারী লোকগুলোর ভয়ে ঘর থেকে বেরোনো যেত না ৷ বন্দুকের নলই একসময় শেষ কথা বলত এখানে ৷ বন্দুকের নলের সেই সন্ত্রাস আজ আর নেই এখানে ৷ পাল্টেছে সরকারও ৷ বাম শাসনের অবসান হয়েছে ৷ জঙ্গলমহল আজ তাদের হয়ে কথা বলার জন্য প্রতিনিধি পাচ্ছে মমতার মন্ত্রিসভায় ৷ দিদির মন্ত্রিসভায় এক-দু’জন নয়… তিনজন মন্ত্রী জঙ্গলমহল থেকে ৷ সন্ধ্যারানি টুডু, জ্যোৎস্না মান্ডি ও বীরবাহা হাঁসদা।
জঙ্গলমহলে তৃণমূলের ঘুরে দাঁড়ানোর কারণ বিশ্লেষণে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের একাংশের মত, রাজ্য সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের সুফল সরাসরি পেয়েছেন মানুষ।আর এই প্রকল্পগুলির হাত ধরেই জঙ্গলমহলের মানুষের আস্থা ফিরে এসেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর। এদিকে ২০২৪ সালে কেন্দ্র থেকে মোদী সরকারকে উৎখাত করতে এখন থেকেই ছক কষা শুরু করে দিয়েছেন তৃণমূলনেত্রী। বিরোধী নেতা-নেত্রীদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আর এর মাঝেই আদিবাসী উন্নয়নের প্রতিও বাড়তি নজর রয়েছে নেত্রীর। তফসিলি উপজাতিদের জন্য উন্নয়ন পরিষদ এই মহলের লোক আগে কখনও ভাবতে পারেননি । বিধানসভা ভোটে জঙ্গলমহলের উজাড় করা সমর্থন পেয়ে চলতি মাসের শুরুতেই ঝাড়গ্রামে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে বিশ্ব আদিবাসী দিবসের রাজ্যস্তরের সরকারি অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন তিনি। নবান্নে তাঁর পৌরহিত্যেই সোমবার আয়োজিত হয় ‘ওয়েস্টবেঙ্গল ট্রাইবস অ্যাডভাইসরি কাউন্সিলে’র বৈঠক। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কর্মকাণ্ড বলে দিচ্ছে তিনি জঙ্গলমহলের বিষয়ে গা-ছাড়া ভাব বরদাস্ত করবে না। জঙ্গলমহলের রাজনীতিকে যাঁরা খুব কাছে থেকে দেখেছেন, তাঁরা বলছেন জঙ্গলমহলের মানুষের মধ্যে যে রক্ত রাগ জমেছিল, তা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে নয় ৷ স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে । কারণ ২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার আসার পর ওই অঞ্চলগুলিতে ব্যাপকভাবে উন্নয়নের কাজ হয়ে থাকলেও মানুষের ক্ষোভ ছিল স্থানীয় নেতাদের ঔদ্ধত্য এবং সরকারের তরফে যে প্রকল্পগুলি আসছে তাতে নেতাদের অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ । উন্নয়নের কাজে মানুষ খুশি হলেও স্থানীয় নেতাদের ঔদ্ধত্যে সেখানকার মানুষ ক্ষুব্ধ ছিলেন। এদিকে একুশের ভোট মিটতেই রাজ্য বিজেপিতে ছন্নছাড়া ভাব ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। এর মাঝেই রাজ্য সরকারের বঞ্চনার প্রসঙ্গ তুলে জঙ্গলমহলে পৃথক রাজ্যের সুর তোলার চেষ্টা করেছেন সৌমিত্র খাঁ- দিলীপ ঘোষরা। কিন্তু দলের অন্দরেই তা নিয়ে তীব্র দ্বন্দ্বের পরিবেশ। এর মাঝে বাঁকুড়া থেকে সুভাষ সরকারকে মন্ত্রী করে মোদী সরকার জঙ্গলমহলের ক্ষোভ প্রশমনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু দিনে দিনে সেখানে ভাঙছে দলীয় সংগঠন। উনিশে জঙ্গলমহলের যে ৫টি আসনে পদ্মফুল ফুটেছিল ২৪-এর লড়াইয়ে সেখানে নতুন করে পদ্ম ফোটানো কিন্তা গেরুয়া শিবিরের পক্ষে এখন সত্যিই চ্যালেঞ্জের।