সীমিত অর্থবলেও থিমভাবনায় অভিনবত্বের ছোঁয়া কলকাতার এই পুজোগুলির
করোনাকালে সব পুজো কমিটিরই বাজেটে টান পড়েছে। অনেকেই জাঁকজমক কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন। কিন্তু সীমিত অর্থবলেও থিমভাবনায় অভিনবত্ব আনতে তাদের চেষ্টার কোনও ত্রুটি নেই। পূর্ব কলকাতার মাঝারি ও বড় পুজো আয়োজকরা এবারও ভাবনার অভিনবত্বে দর্শকদের চমৎকৃত করতে আসরে নেমেছেন। বাঙালির শারদোৎসব স্রেফ পুজো বা আরাধনার গণ্ডি ছাড়িয়ে সৃজনশীলতার আধার হয়ে উঠেছে অনেকদিন আগেই। শহরের পূর্ব প্রান্তের বেশ কয়েকটি পুজো কমিটি এবারও দর্শক টানার পরিকল্পনা করেছে। কেউ আবার সবেকি ঘরানার পুজো আয়োজন করে ফিরে দেখতে চাইছে অতীতের দিনগুলি।
নয়ের দশকের শেষের দিকে ভাঁড়ের মণ্ডপ করে হইচই ফেলে দিয়েছিল কসবার বোসপুকুর শীতলা মন্দির। এবারও তারা থিমের আশ্রয়ে। চলতি বছরে তাদের মণ্ডপসজ্জায় ফুটে উঠবে ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলি। থিমের শিরোনাম ‘টান’। থিমশিল্পী গোবিন্দ গিরি বলেন, ‘মণ্ডপ তৈরি হচ্ছে এক বিশাল হুঁকোর আদলে। ধূমপানে ক্ষতিগ্রস্ত ফুসফুসের অবস্থা কেমন হয়, তাও প্রতিভাত হবে মণ্ডপসজ্জায়।’ এক পুজোকর্তার বক্তব্য, ‘সাময়িক এই সুখটান উপেক্ষা করে আমরা যেন ভক্তি ও প্রেমের পথ ধরে মায়ের টানে মিলতে পারি, সেটাই প্রার্থনা।’
বোসপুকুরের তালবাগান সর্বজনীনের এবারের থিম ‘ধরো হাল শক্ত হাতে’। কৃষিপ্রধান দেশ ভারতবর্ষে কৃষকরা কেমন আছেন? কেন মাসের পর মাস রাজপথে পড়ে থেকে আন্দোলন চালাতে হচ্ছে অন্নদাতাদের? এই প্রশ্নগুলি দর্শকের ভাবনাকে উস্কে দেবে বলেই আশাবাদী আয়োজকরা। তালবাগান সর্বজনীনের কার্যকরী সভাপতি শুভেন্দু ঘোষ জানান, দেবী এখানে দেখা দেবেন শাকম্ভরী রূপে। মায়ের যে শান্ত, সৌম্য রূপ, তার মাধ্যমে যে সুজলা-সুফলা শস্যশ্যামল ধরাধামের যে আভাস ফুটে ওঠে, তাকেই আমরা এবার আবাহন করব। দিল্লিতে যে কৃষক আন্দোলন চলছে, তাতে মূলত অংশ নিচ্ছেন পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থানের কৃষকরা। তাই সেই রাজ্যগুলির অনুসঙ্গ তুলে আনতে থাকবে সেখানকার লোকসংস্কৃতির ছোঁয়া। থাকবে বিশাল ট্রাক্টরের আদলে সাজসজ্জা।’
গত কয়েকবছরে মহানগরের পুজো মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে রাজডাঙা নব উদয় সঙ্ঘ। এবার তাদের থিম ‘ছবির কোলাজ’। থিমশিল্পী মলয় রায় এবং শুভময় সিনহা বলেন, চারদিনের পুজো হলেও তার প্রস্তুতি শুরু হয় অনেক আগে থেকে। আকাশে পেঁজা তুলো মেঘের আনাগোনা, নদীর পাড়ে কাশফুলের দোলায় আগমনী গান বেজে ওঠে। এসব পর্যায় ধরা থাকে আলোকচিত্রীর ক্যামেরার ফ্রেমে। পুজোর আড্ডা থেকে দশমীর সিঁদুরখেলা—মনে চলে হাজারো ছবির আনাগোনা। এই কল্পচিত্রকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টায় রয়েছি। পুজোর সভাপতি সুশান্ত ঘোষ বলেন, ‘বাজেট কমলেও আমরা কোনও খামতি না রাখারই চেষ্টা করছি।’
তিলজলার সুনীলনগরের পুজো এবার ৭২ বছরে পড়ল। তাদের এবারের থিম ‘দূরত্ব’। মারণ ভাইরাসের থেকে বাঁচতে শারীরিক দূরত্ব দরকারি, কিন্তু তা আমাদের মধ্যে যেন মানসিক দূরত্ব তৈরি না করে। এই ভাবনাই এখানকার মণ্ডপসজ্জায় ফুটিয়ে তুলছেন শিল্পী সোমনাথ মুখোপাধ্যায়। পুজোর সম্পাদক বিকাশচন্দ্র দে বলেন, ‘কলকাতার থিমপুজোয় আমরাও অন্যতম পথিকৃৎ। সেই ঐতিহ্যই আমরা বজায় রাখব। এত সব অভিনব থিমভাবনার মধ্যে থাকছে সাবেকি ঘরানার মাতৃবন্দনাও।’ আনন্দপুরের আর আর প্লটের পুজো এবার ২৪ বছরে পড়ল। পুজোকর্তা নলিনীরঞ্জন সিনহা বলেন, করোনার কারণেই এবার আমরা থিমের পথে হাঁটিনি। মণ্ডপ সেজে উঠবে নাটমন্দিরের আদলে। সেখানে পূজিত হবেন সাবেকি মহিষাসুরমর্দিনী মা।