ভবানীপুরের জয়ে আক্ষেপের সুর নন্দীগ্রামে
ভবানীপুর উপনির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জয়ী হয়েছেন বিপুল ভোটে। খবরটা সংবাদমাধ্যমে পেতেই নন্দীগ্রামের তৃণমূল নেতাদের মধ্যে চাপা পড়ে যাওয়া যন্ত্রণাবোধ আরও এক বার তীব্র হয়ে উঠল। সেই নন্দীগ্রাম, যা তৃণমূলের জমি আন্দোলনের ধাত্রীভূমি। সেই নন্দীগ্রাম, যাকে ‘মেজোবোন’ আখ্যা দিয়ে গত বিধানসভা ভোটে সেখান থেকে নিজেই প্রার্থী হয়েছিলেন মমতা। সেই নন্দীগ্রাম, যা মমতাকে ফিরিয়েছিল জয়ের থেকে সামান্য দূরে রেখে।
রবিবার দুপুরে তখন সদ্য ঘোষণা হয়েছে তৃণমূলনেত্রীর জয়। সেই খবর ছড়িয়ে পড়তে না পড়তেই ময়দানে নামেন মমতা। কালীঘাটের বাড়িতে করেন সাংবাদিক বৈঠক। তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘নন্দীগ্রামে চক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু সব চক্রান্তকে জব্দ করে দিয়েছেন বাংলার মানুষ, ভবানীপুরের মানুষ। তাঁরা আমাকে আরও কাজ করার প্রেরণা যুগিয়েছেন। আমি চিরঋণী।’’ অথচ এমন একটি নাটকীয় মুহূর্ত যে মাস পাঁচেক আগে অর্থাৎ ২ মে তৈরি হতে পারত, তা মানছে নন্দীগ্রামের তৃণমূল শিবির। ভবানীপুরের বিপুল জয় সেই পুরনো ক্ষতে ঘা দিয়েছে আরও এক বার। নন্দীগ্রামে মমতার মুখ্য নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন শেখ সুফিয়ান। তিনি বলছেন, ‘‘সে দিনের হারের জন্য আমরা আজও মর্মাহত।’’ হারের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সুফিয়ানের অভিযোগ, ‘‘এখানে জেতার জন্য বিজেপি মেরুকরণ, ভোট লুঠ, গ্রামে গ্রামে উপঢৌকন বিলি, গণনা কেন্দ্রে কারচুপি সবই করেছে। পরের বার সুযোগ পেলে নন্দীগ্রামের মানুষ এর জবাব দেবে।’’
নন্দীগ্রামে হারের যন্ত্রণা, আবার ভবানীপুরের জয়ে ‘সুখের মতো ব্যথা।’ এই পরিস্থিতির বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সুফিয়ান বলছেন, ‘‘ভবানীপুরের মানুষ গোটা দেশকে পথ দেখাবে। দলনেত্রীর বিপুল জয় রাজ্যের প্রতিটি কোণে থাকা তৃণমূল নেতা এবং কর্মীদের আরও উজ্জীবিত করবে।’’ নন্দীগ্রামে হার হলেও জোড়াফুল শিবিরের একটি অংশের অবশ্য ব্যাখ্যা, বিজেপি-র বিরুদ্ধে রাজনৈতিক যুদ্ধে নিজে ওই কেন্দ্র থেকে লড়াইয়ের ঘোষণা করে গোটা দলকে কোমর বেঁধে নামার বার্তা দিয়েছিলেন মমতা। তৃণমূল নেতৃত্বের একটি অংশের দাবি, সেনাপতি হিসাবে দলনেত্রী যে ঠিক কাজই করেছিলেন তার প্রমাণ মিলেছে ২ মে-তেই।
গত ১৮ জানুয়ারি নন্দীগ্রামে সভা করেন মমতা। তখন বিধানসভা ভোটের দামামা বেজে গিয়েছে। বিশাল জনসভায় তিনি ঘোষণা করেন, নন্দীগ্রাম থেকে দাঁড়ানোর। বলেন, ‘‘ভবানীপুর আমার বড় বোন। নন্দীগ্রাম মেজো বোন। দুই বোনকেই আমি ভালবাসি।’’ মেজো বোন ‘ফিরিয়ে’ দিলেও, ‘বড় বোন’ ভবানীপুর অবশ্য মমতাকে ‘ফিরিয়ে’ দিয়েছে বিধানসভায়। দুই কেন্দ্রের দুই ফল নিয়ে নন্দীগ্রাম এক নম্বর ব্লকের সভাপতি স্বদেশ দাসের বিশ্লেষণ অবশ্য ভিন্ন। অন্তর্ঘাতের তত্ত্ব উস্কে স্বদেশ বলছেন, ‘‘শুভেন্দু অধিকারী ক্ষমতায় থাকাকালীন নন্দীগ্রামে তাঁর একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই ভোটের সময় তৃণমূলের নিচুতলার একাধিক নেতাকে হাত করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি মেরুকরণের নোংরা খেলায় মানুষকে বিভ্রান্তও করে দিয়েছিলেন শুভেন্দু।’’ তবে স্বদেশ এ-ও বলছেন, ‘‘ভবানীপুরে দলনেত্রী যে বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন তার জন্য নন্দীগ্রামের মানুষ আপ্লুত। মেজো বোন ব্যর্থ হলেও বড় বোন কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এনে দেওয়ায় আমরা ভীষণ খুশি।’’
ভবানীপুরের জয় নিয়ে অবশ্য কটাক্ষের সুর নন্দীগ্রামের পদ্মশিবিরের। নন্দীগ্রামের বিজেপি নেতা প্রলয় পালের মতে, ‘‘ভবানীপুর কেন্দ্রে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি মানুষ ভোট দিতে আসেননি। তার মানে সেখানকার অর্ধেকের বেশি মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান না।’’ তাঁর দাবি, ‘‘প্রশাসনিক ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে ভবানীপুরে একপেশে ভোট করিয়েছে তৃণমূল। মুখ্যসচিব নির্বাচন কমিশনের কাছে ভবানীপুরে ভোট করাতে বলেছেন। এর থেকে পরিষ্কার গোটা চিত্র।’’ প্রলয়ের মত, ‘‘নন্দীগ্রামের মানুষ প্রতিবাদ করতে ভয় পান না। তারই ফল পেয়েছিল বিজেপি। ভবানীপুরে মানুষ ভোট দিতে পারলে, সন্ত্রাসমুক্ত ভোট হলে ওখানেও হারের মুখ দেখতে হত।’’
নন্দীগ্রামে এক হাজার নশো ছাপ্পান্ন ভোটে জিতেছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। রবিবার তাঁর শিবিরের প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়ালকে ৫৮ হাজার ৮৩৫ ভোটে হারিয়েছেন মমতা। ভবানীপুরে জয়ের হ্যাটট্রিকও করলেন। সেই সঙ্গে পূর্ণ করে দিলেন নন্দীগ্রামে টেনে দেওয়া অর্ধবৃত্তটিও।