বিবিধ বিভাগে ফিরে যান

মহালয়া দুঃখের দিন না আনন্দের? কী বলছে শাস্ত্র, জেনে নিন

October 6, 2021 | 5 min read

ইদানিং কয়েকবছর ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘শুভ মহালয়া’ শুভেচ্ছাজ্ঞাপন নিয়ে দুই পক্ষের মতবিরোধ চলছে। একদলের মত, মহালয়ার সঙ্গে দেবী দুর্গার কোনও সম্পর্ক নেই এবং এটি পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে তর্পণের দিন হওয়াতে একে কিছুতেই ‘শুভ’ বলা যাবে না। এদিকে, অন্য পক্ষ দেখছেন, মহালয়ার দিন শারদীয়া দুর্গোৎসবের উদবোধন হচ্ছে, প্যাণ্ডেল হপিং শুরু হয়ে যাচ্ছে, দীর্ঘ ছুটি পড়ে যাচ্ছে, এবং সর্বোপরি আকাশবাণীর ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ তো আছেই। তাহলে তারাও কেন শুভ মহালয়া বলতে পারবেন না, প্রশ্ন তুলছেন।

শাস্ত্র কি বলে?

পিতৃপুরুষের তর্পণ কি কোনওভাবে শোকের বা অশুভ কিছু? প্রথমত, হিন্দু শাস্ত্র বলতে মুখ্যত বেদ, উপনিষদ এবং গীতাকেই বোঝায়। বেদ-উপনিষদের সারাৎসার “অমৃতরূপ দুগ্ধ” গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় সাংখ্যযোগের ২৭ নম্বর শ্লোকে, শ্রীভগবানের মুখে বেদব্যাস রচনা করেছেন এইরকম কথা, যে জন্মেছে তার জন্য মৃত্যু নিশ্চিত আবার যার মৃত্যু হয়েছে তার পুনর্জন্মও নিশ্চিত (কারণ ‘আত্মজ্ঞান’ লাভ করে মুক্তি না হওয়া অবধি এই জন্ম-মৃত্যুর চক্র চলতেই থাকবে), অতএব যা নিশ্চিত তার জন্য শোক করা নিতান্ত মূর্খামি। ‘ন হন্যতে’ ইত্যাদি শ্লোক তো জানা আছেই। তাহলে পিতৃপুরুষের পার্বণ শ্রাদ্ধ কেন শোকের হবে?

সদ্যমৃত প্রেতের একোদ্দিষ্ট শ্রাদ্ধ এবং অশৌচান্তে আদ্যশ্রাদ্ধও শাস্ত্রানুযায়ী শোকের নয়, তবে সদ্য প্রিয়জনের বিয়োগব্যথার কারণে ‘মায়াবদ্ধ’ জীবের কাছে সেটি শোকের। কিন্তু অন্নপ্রাশন এবং বিবাহের শুরুতে যে বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ হয় সেটি, অথবা চান্দ্র ভাদ্রের পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা (মহালয়া) অবধি যে অপরপক্ষীয় পার্বণশ্রাদ্ধ হয় তাতে শোকের জায়গা কোথায়? হিন্দুশাত্রোক্ত এই তিনধরনের শ্রাদ্ধের ক্রিয়াকালও ভিন্ন। বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ হয় পূর্বাহ্নে, একোদ্দিষ্ট এবং আদ্যশ্রাদ্ধ মধ্যাহ্নে এবং বাৎসরিক সপিণ্ডীকরণ ও অপরপক্ষীয় পার্বণশ্রাদ্ধ অপরাহ্নে কৃত্য। বাঙালি সমাজের লোকাচারে পিণ্ডদান সম্পর্কে অদ্ভুত ভীতিপ্রদ কিছু ধারণা বিদ্যমান, যার কোনও শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা নেই।

সেগুলি এরকম, যাদের পিতা-মাতা বর্তমান তারা পিণ্ডদান দেখতে পারবে না, এমনকি শ্রাদ্ধসম্পর্কিত কোনও কিছুই করতে পারবে না ইত্যাদি এবং এতে তাদের পিতা-মাতার জীবনহানির আশঙ্কা রয়েছে। অথচ এ অতি পুণ্য কাজ এবং শাস্ত্রমতে এটিই অন্যতম ‘কাজ’ যা ক’রে শতবর্ষব্যাপী ধার্মিক জীবন যাপন শেষে দেবদুর্লভ পিতৃলোকে গমন সম্ভব। অর্থাৎ, প্রেতের শ্রাদ্ধে শোকের অনুষঙ্গ থাকলেও বৃদ্ধিশ্রাদ্ধে বা পার্বণ শ্রাদ্ধে শোক ত নয়ই, বরং উদ্‌যাপনের অনুষঙ্গ রয়েছে। হিন্দু শাস্ত্রানুযায়ী এই সাতপুরুষকে জল দেওয়ার রীতিও বড় মায়াময়।

আস্তিক-নাস্তিক-সংশয়বাদী, যেই হোক না কেন, কোনওভাবেই পিতৃপুরুষকে অস্বীকার করতে পারবে না। এক্স-ওয়াই সহ সমস্ত ক্রোমোজোম যেখান থেকে পাওয়া গেছে, সেই মানুষগুলোকে অস্বীকার করবার কোনো উপায় আছে? মার্কণ্ডেয় ঋষির কাব্যই হোক বা পুরাকালে বাস্তবে মহিষাসুর আদৌ বধ হয়ে থাকুক না কেন, সেই চর্চা মানুষের পক্ষে ‘সাধনা’র বিষয়। কিন্তু পিতৃপুরুষদের বচ্ছরে অন্তত একদিন স্মরণ করা, সেটি তো ভীষণ ভাবেই মানবিক। কেউ নাস্তিক হলেও, পিতৃলোকে অবিশ্বাসী হলেও, তার পিতৃপুরুষদের অতীতকে অবিশ্বাস করতে পারেন না। তাঁরা ছিলেনই। কেউ যদি পিতৃকুল সম্পর্কেই অনবহিত থাকেন অথবা বীতশ্রদ্ধ হন, তাহলেও এই দিনটি তার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ হিন্দুশাস্ত্র পিতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে পাঁচরকম পিতার উল্লেখ করেছে, এবং বীর্যদাতা পিতাকে শেষের দিকেই রেখেছে।

শাস্ত্র বলছে, যিনি অন্ন দেন (পালনকারী পিতা), যিনি ভয় দূর করেন (অন্ধকার থেকে যিনি আলোয় নিয়ে যান তাই অন্ধকারের ভয় দূর হয়, গুরু, শিক্ষক প্রমুখ), যিনি কন্যাদান করেন (শ্বশুর), যিনি বীর্যদান করেন (বায়োলজিকাল ফাদার), যিনি উপনয়ন দান করেন (পুরাকালে সকল বর্ণেরই উপনয়নের ব্যবস্থা ছিল) এনারা সকলেই পিতা। এখন কেউ বীর্যদাতা পিতার উদ্দেশ্যে তর্পণ করলেন নাম গোত্র উল্লেখ করে, কিন্তু প্রণাম করবার সময় তিনি এই পাঁচ পিতাকেই প্রণাম করলেন। চাইলে তিনি এই পাঁচজনকেই জলদান করতে পারেন।

বাংলায় যে সাতপুরুষ, চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করি, এরাই বা কারা? পিতৃকূলে পিতা, পিতামহ, প্রপিতামহ, মাতৃকূলে মাতামহ, প্রমাতামহ এবং বৃদ্ধ প্রমাতামহ। এনারা ত হলেন পূর্বতন ছয় পুরুষ ও সপিণ্ডের অধিকারী। এই ছয়পুরুষকে দেবার আগে প্রথম পিণ্ডদান করা হয় অগ্নিদগ্ধ, অস্ত্রাঘাতে হত ইত্যাদি অপঘাতে মৃত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে। চোদ্দপুরুষ বলতে এনাদের সকলের স্ত্রীসহ বোঝানো হয়। মহালয়ার দিন পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যা অবধি ষোলো দিনের, মোট ষোলোটি পিণ্ডদানের নির্দেশ রয়েছে শাস্ত্রে। অপারগ হলে কেউ পনেরোদিন ধরে, কেউ অষ্টমী থেকে আটদিনের, তাও না পারলে একাদশী থেকে পাঁচটি, তাতেও অপারগ হলে ত্রয়োদশী থেকে তিনদিন পার্বণ শ্রাদ্ধ করার নির্দেশ রয়েছে৷ মহালয়ার দিন তিনভুবনের সমস্ত জীবের তৃপ্তির জন্য জলদান করা হয়। একে শোকের বলা হবে কোন অমানবিকতায়?

একইরকমভাবে কার্তিকমাসে দীপদান হয়। আজ যে কালীপুজোয়-দীপাবলীতে বাজি পুড়িয়ে কেবল দূষণফূর্তি করা হয়, এটি আসলে শাস্ত্রোক্ত কর্ম, যার নাম উল্কাদান। সেখানেও প্রথমে ওই অপঘাতে মৃতব্যক্তিদের নাম করে উল্কাদান করে বাকি সকলের জন্য উল্কাদান করা হয়। সারা কার্তিক মাসভর প্রদীপ জ্বেলে রাখতে হয়, পূর্বপুরুষরা উত্তরসূরিদের দেখতে আসবেন বলে।

তাই এটুকু বোঝাই যায়, দুনিয়ার সমস্ত ধর্মেই পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানানোর রীতি-রেওয়াজ রয়েছে, তবে তা শোকের সঙ্গে নয়, সংযমের সঙ্গে। অবশ্যই মহালয়ায় পিতৃতর্পণের সঙ্গে ঢাক-ঢোল বাজানোর অনুষঙ্গ নেই, কিন্তু তা বলে শোকের আবহও কিছু নেই।

যদি শুক্লযজুর্বেদের সংহিতা অংশের ঈশোপনিষদে যাওয়া যায়, যেখানে ‘আত্মজ্ঞান’-কেই পরমগতি বলে বর্ণনা করা হয়েছে, এবং কোনও দেবতা বা স্রষ্টার উপাসনার কথা নেই, সেখানে দেখা যাবে ‘অবিদ্যা’ এবং ‘বিদ্যা’-র কথা বলা হয়েছে। এই উপনিষদের প্রথম শ্লোকে ত্যাগের দ্বারা ভোগের কথা বলা হয়েছে এবং দ্বিতীয় শ্লোকেই যারা ত্যাগ করতে পারবেন না ‘সংসারের’ মোহ-মায়া; তাদের একশো বছর ধরে জীবন যাপনের দিকনির্দেশ করা হয়েছে। অদ্বৈতবেদান্তী আচার্য শংকরের ভাষ্যের উপর ভিত্তি করে স্বামী নিখিলানন্দ বলছেন, শাস্ত্রোক্ত কর্ম করেই বেঁচে থাকতে হবে সংসারীদের, যার উদাহরণ, অগ্নিহোত্র (বৈদিক ক্রিয়াকাণ্ড, যজ্ঞ, দশবিধ সংস্কার, পিতৃকর্ম ইত্যাদি)। পিতৃপুরুষের তর্পণ অন্যতম শাস্ত্রোক্ত ‘কর্ম’ যা করতেই হবে গৃহীদের। এমনকি সন্ন্যাসীরাও, সন্ন্যাস ব্রত গ্রহণের পূর্বে এই কর্ম সমাধা করে তবেই সন্ন্যাস গ্রহণ করেন।

এরপর উপনিষদের নবম ও দশম শ্লোকে এসেছে বিদ্যা ও অবিদ্যার প্রসঙ্গ। সেখানে বেদের ঋষি বলছেন, যারা অবিদ্যারূপ ‘কর্ম’ করে তারা ‘অন্ধকারে’ যায়, কিন্তু যারা বিদ্যারূপ ‘জ্ঞান’চর্চা করে তারা আরও ‘গভীর অন্ধকারে’ ঢুকে যায়। এই অবিদ্যা ও বিদ্যার প্রসঙ্গে কর্মমার্গ ও জ্ঞানমার্গ ভালো করে বুঝতে হলে পড়তে হবে বৃহদারণ্যক উপনিষদ।

Mahalaya 2021 auspicious or ominous know significance and importance

ঈশোপনিষদে, ‘জ্ঞান’মার্গ বলতে জ্ঞানের দ্বারা ইষ্টসাধনফল লাভ নিমিত্ত কোনও দেবতার উপাসনার কথা ইঙ্গিত করা আছে এবং ‘কর্ম’মার্গ বলতে জাগতিক সুখভোগের নিমিত্ত ক্রিয়ানুষ্ঠানের কথা বলা হয়েছে। পিতৃপুরুষের তৃপ্তির জন্যে জলদান, গৃহীর অবশ্যকর্তব্য এবং তা তার সাংসারিক সুখের কামনাতেই করা, যাতে পিতৃপুরুষের আশীর্বাদে জীবিত ব্যক্তির সংসার সুখের হয়।

এখন ‘কর্ম’ করলে মৃত্যুর পর মানুষ পিতৃলোকে যাবেন, যেখানে পুণ্যকর্মসুখভোগের পর আবার পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে এবং পুনরায় কর্মের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত ত্যাগের পথেই যেতে হবে মুক্তি লাভের জন্য। কিন্তু ‘জ্ঞান’ মার্গে দেবতার উপাসনা করলে মৃত্যুর পর দেবলোক-চন্দ্রলোকে (স্বর্গে) গিয়ে সেখানে জাগতিক সুখের সেরা উপাদান দেখে পৃথিবীর দুঃখের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে চরম সুখভোগ করবেন ঠিকই, কিন্তু তা তো চিরস্থায়ী নয় ফলতঃ পুনরায় জন্ম নিয়ে কর্মের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হতেই হবে। এই দেবলোক অর্থাৎ স্বর্গে বাসকারীরা চরম ভোগসুখে ‘পরম আত্মজ্ঞান’ লাভের কথা ভুলে যান। তাই তাঁরা ‘ঘোর অন্ধকারে’ ডুবে যান। একারণেই এই দুই শ্লোকের পরবর্তী শ্লোকে বলা আছে ‘বিদ্যা-অবিদ্যা’ দুইয়েরই চর্চা করতে হবে, যাতে এই দুই লোকের পারে গিয়ে ‘আত্মজ্ঞান’ লাভে সমর্থ হয় মানুষ।

এখন ভাবতে হবে, মহালয়ার তর্পণ ‘কর্ম’ করতেই হবে আমাদের। একে ছেড়ে যদি শুধু চতুর্বর্গ ফল লাভের আশায় ‘কলির অশ্বমেধ’ দুর্গাপূজায় আমরা ব্রতী হই, তখন ‘ধর্ম-অর্থ-কাম-মোক্ষ’ সাধক পাবেন ঠিকই, কিন্তু শাস্ত্রোক্ত ‘ঘোর অন্ধকারে’ পতিত হবেন। আবার শুধু তর্পণ করলেই হবে না, আমাদের সাধ্যানুযায়ী কৃষ্ণানবমী বা অন্যান্য কল্পে আদ্যাশক্তির বোধন করে ‘সাধনা’ও করতেই হবে। তাই শাস্ত্রানুযায়ী, পিতৃপুরুষের তৃপ্তির জন্য জলদান ‘কর্ম’ ও শারদীয়া দুর্গাপুজোর ‘সাধনা’ দুইই করতে হবে, নইলে জন্ম-মৃত্যুর শৃঙ্খল থেকে মুক্তি নেই। তাই মহালয়া অতি পুণ্যের দিন, শুভ দিন।

TwitterFacebookWhatsAppEmailShare

#Mahalaya

আরো দেখুন