বাংলার চার বিধানসভা আসনে আজ উপনির্বাচন
২ মে ফল ঘোষণার সময় দেখা গিয়েছিল, তৃণমূল পেয়েছে ২১৩টি আসন। বিজেপি জয় পেয়েছে ৭৭টিতে। তবে মোট আসন ছিল ২৯২। কারণ, তখন প্রার্থী মৃত্যুর কারণে ভোট হয়নি মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর ও শমসেরগঞ্জে। এক মাস আগে সেই দু’টি আসন তৃণমূলের ঝুলিতে গিয়েছে। অন্য দিকে, ভবানীপুর থেকে মন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের জায়গায় বিধায়ক হয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য দিকে, ফল ঘোষণার আগেই মৃত্যু হয় খড়দহের তৃণমূল প্রার্থী কাজল সিংহের। ফল প্রকাশের পর দেখা যায় তিনি ওই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছেন। আবার ফলপ্রকাশের পর গোসাবার জয়ন্ত নস্করের মৃত্যুতে তৃণমূলের বিধায়ক সংখ্যা কমে যায়। পাশাপাশি বিজেপি-র কোচবিহারের সাংসদ তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক এবং রানাঘাটের সাংসদ জগন্নাথ সরকার যথাক্রমে দিনহাটা ও শান্তিপুরের বিধায়ক পদ ছেড়ে দেন। এর পরে বিজেপি-র আরও পাঁচ বিধায়ক দলত্যাগ করে তৃণমূলে গেলে আপাতদৃষ্টিতে এখন তৃণমূলের শক্তি ২১৩ এবং বিজেপি-র ৭০।
সেই আবহে রাজ্যের চার আসনে উপনির্বাচন। তৃণমূলের কাছে রয়েছে মে মাসের ফলের থেকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ। চারটি আসনেই জয় পেলে বিধানসভায় ২১৭ হবে ঘাসফুলের শক্তি। অন্য দিকে বিজেপি-র কাছে জেতা দিনহাটা ও শান্তিপুর ধরে রাখার লড়াই। সেটাও যে খুব সহজ নয়, সেটা জেনে বিজেপি শিবির চাইছে অন্ততপক্ষে শান্তিপুর আসনটাও যেন ধরে রাখা যায়।
উত্তরের দিনহাটা আসনে বিজেপি জিতলেও খুব বেশি ব্যবধান ছিল না সাংসদ নিশীথের। গত বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে সাতটি আসনে ব্যবধান ছিল ১ হাজারের কম ভোট। তার মধ্যে আবার সবার নীচে দিনহাটা। নিশীথ জেতেন মাত্র ৫৭ ভোটে। বিজেপি পেয়েছিল শতাংশ ৪৭.৬ ভোট। সেখানে তৃণমূলের উদয়ন গুহ পেয়েছিলেন ৪৭.৫৮ শতাংশ ভোট। মাত্র ০.২ শতাংশের ব্যবধানে হেরে যাওয়া উদয়ন এ বার ফের প্রার্থী। বিজেপি প্রার্থী অশোক মণ্ডল আদৌ নিশীথের মতো হাড্ডাহাড্ডি লড়াই দিতে পারবেন কি না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে গেরুয়া শিবিরেই। এই আসনে রাজবংশী ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত বিধানসভা নির্বাচনের সময়ে রাজবংশী ভোট একত্রিত করতে বিজেপি খুবই জোর দেয়। সেই সঙ্গে শীতলখুচির ঘটনাও প্রভাব ফেলেছিল দিনহাটার ভোটগ্রহণে। তা সত্বেও কোনওক্রমে জয় পাওয়া দিনহাটা এই উপনির্বাচনে ধরে রাখা খুবই কঠিন বিজেপি-র কাছে। কারণ, উপনির্বাচনে সাধারণ ভাবে ভোটের হার কম হয়। প্রসঙ্গত, এপ্রিল মাসের নির্বাচনে এখানে ভোট পড়েছিল ৮১.৪৫ শতাংশ। তবে রাজবংশী ভোট টানতে এ বার প্রার্থী অশোকের পরিবর্তে নিশীথকে সামনে রেখেই প্রচার চালিয়েছে বিজেপি। সেখানে নিশীথকে সদ্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রী করার বিষয়টিও তুলেছে গেরুয়া শিবির।
নদিয়ার শান্তিপুর আসনেও জয় পেয়েছিল বিজেপি। তবে দিনহাটার মতো এত কম ভোটে নয়। সাংসদ জগন্নাথ জেতেন ১৫ হাজার ৮৭৮ ভোটে। ভোট প্রাপ্তি ছিল ৪৯.৯৪ শতাংশ। সেখানে তৃণমূলের অজয় দে পান ৪২.৭২ শতাংশ। অনেকের ধারণা, এই কেন্দ্রে মতুয়া ভোট একটা বড় ভূমিকা নিয়েছিল। এ বার যে চার আসনে উপনির্বাচন তার মধ্যে পরিসংখ্যানের বিচারে এই কেন্দ্রেই লড়াইয়ের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এখানে ব্রজকিশোর গোস্বামীকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। জয়ের বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। নিশ্চিন্তে তৃণমূলও। তবে বিজেপি-র প্রার্থী নিরঞ্জন বিশ্বাসের পাল্টা দাবি, শান্তিপুরে জয়ের দিবাস্বপ্ন দেখছে তৃণমূল। প্রচারে সেই সুর শোনা গিয়েছে, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর গলাতেও। বিজেপি শিবিরের বক্তব্য, শান্তিপুরে জয়ের জন্যই ঝাঁপাচ্ছে দল। তবে গেরুয়া শিবিরেরই একাংশের বক্তব্য, তৃণমূল জিতলে ততটা সমস্যা নেই। কিন্তু শান্তিপুর-সহ চার আসনেই দ্বিতীয় হতেই হবে। উপনির্বাচনে হার লজ্জার নয় কিন্তু প্রধান বিরোধী দল হিসেবে গুরুত্ব যেন বজায় থাকে।
উত্তর ২৪ পরগনার খড়দহ কেন্দ্রের লড়াই অনেকটাই সহজ। এপ্রিলের ভোটে এক বেদনাদায়ক ঘটনার সাক্ষী হয় এই আসন। ভোটগ্রহণের পরেই করোনা সংক্রমণ হয় কাজল সিংহের। আর গণনার আগেই মৃত্যু। জানতেও পারেননি যে তিনি ২৮ হাজার ১৪০ ভোটে হারিয়ে দিয়েছেন বিজেপি-র টিকিটে লড়া প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক শীলভদ্র দত্তকে। ভোটে হারা শীলভদ্র উপনির্বাচনে আর প্রার্থী হতে চাননি। বিজেপি প্রার্থী করেছে অখ্যাত জয় সাহাকে। আর উল্টো দিকে রাজ্যের কৃষিমন্ত্রী শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। ভবানীপুরে জিতেও মুখ্যমন্ত্রীর জন্য ছেড়ে তিনি এসেছেন খড়দহে। ভোটের অঙ্কেও অনেকটাই এগিয়ে তৃণমূল তথা শোভনদেব। ব্যারাকপুরের সাংসদ অর্জুন সিংহকে সামনে রেখে লড়লেও গেরুয়া শিবিরের কেউই এখানে ভাল ফলের আশা করছেন না।
একই অবস্থা দক্ষিণ ২৪ পরগনার গোসাবা আসনেও। এই জেলায় বিজেপি-র শক্তি নেই বললেই চলে। যদিও দ্বিতীয় স্থান ধরে রাখতে পেরেছিল এপ্রিলের ভোটে। প্রয়াত তৃণমূল বিধায়ক জয়ন্ত নস্কর জিতেছিলেন ২৩ হাজার ৭০৯ ভোটের ব্যবধানে। তিনি পেয়েছিলেন ১,০৫,৭২৩ ভোট। ৫৩.৯৯ শতাংশ। সেখানে বিজেপি-র চিত্ত প্রামাণিক পান ৮২ হাজার ১৪ ভোট। ৪১.৮৮ শতাংশ। ভোটে পরাজয়ের পরে চিত্ত চলে যান তৃণমূলে। বিজেপি-র প্রার্থী হয়েছেন পলাশ রানা। অন্য দিকে, তৃণমূলের সুব্রত মণ্ডল। গত বিধানসভা নির্বাচনে এই আসনে ৮৫.০৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল। সেই হার কম হলে তৃণমূল আরও ব্যবধান বাড়াবে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
গত বিধানসভা নির্বাচনের প্রচারে রাজ্যের প্রায় সব আসনই ছুঁয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই উপনির্বাচনের প্রচারে তিনি অবশ্য অংশ নেননি। প্রচারে বড় ভূমিকা নেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। অন্য দিকে, বিজেপি তারকা প্রচারকের লম্বা তালিকা প্রকাশ করলেও সে ভাবে হাওয়া তুলতে পারেনি।
চার আসনের মানুষের রায় জানা যাবে আগামী মঙ্গলবার। তার আগে তৃণমূল শিবিরের স্বপ্ন রাজ্যে বিধায়ক সংখ্যা বাড়িয়ে ২১৭ করে ফেলা। আর বিজেপি-র কাছে চ্যালেঞ্জ আসন আরও না কমতে দেওয়া।
শুক্রবারই ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে পৌঁছে গিয়েছেন ভোটকর্মীরা। বুথের চারপাশে ২০০ মিটার এলাকায় জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সব বুথেই এবার মোতায়েন থাকবে কেন্দ্রীয় বাহিনী। শুক্রবারই বিভিন্ন বুথে তাঁরা চলে গিয়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে নাকা চেকিং। কারা এলাকায় ঢুকছে, কারা বেরচ্ছে, তার উপর কড়া নজরদারি চালাচ্ছে পুলিস। এই উপনির্বাচনে করোনা সতর্কতার বিষয়গুলিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। সেই মতো সংশ্লিষ্ট জেলাশাসক, পুলিস প্রশাসনকে নির্দেশ পাঠানো হয়েছে। ঠিক হয়েছে, লাইনে ছ’ফুট দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াতে হবে ভোটারদের। তা নিশ্চিত করবে পুলিস। পোলিং এজেন্টদের করোনা টিকার দু’টি ডোজ নিতেই হবে বা ৭২ ঘণ্টা আগে আরটিপিসিআর পরীক্ষার মাধ্যমে নিজেকে করোনামুক্ত বলে ঘোষণা করতে হবে। তবেই বুথের ভিতরে ঢুকতে পারবেন তাঁরা। তবে গোসাবা সহ অন্যান্য জায়গায় এদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত অনেক পোলিং এজেন্ট টিকার দু’টি ডোজ নেননি বা আরটিপিসিআর পরীক্ষা করাননি বলে খবর।
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গিয়েছে, আজ চারটি কেন্দ্রের ৬৩৬টি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের ১ হাজার ৪৩৯টি বুথে ভোট নেওয়া হবে। মোট নির্বাচকের সংখ্যা ১০ লক্ষ ১৬ হাজার ৭৬৬। সব মিলিয়ে মোট ১৮ জন প্রার্থীর ভাগ্য নির্ধারিত হবে এদিন। ৭৬০টি ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে থাকছে ওয়েব কাস্টিং। পুরো ভোটগ্রহণ পর্বে নজরদারি চালাবেন ১২ জন পর্যবেক্ষক এবং ১৭৭ জন মাইক্রো অবজার্ভার।